কোটা আন্দোলনের নেতার ইউটার্ন

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী সংগঠনের তিন নেতাকে তুলে নিয়ে চোখ বেঁধে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে এক নেতা যে বর্ণনা দিয়েছেন, অস্বীকার করেছেন অপর জন। নুরুল হক জানিয়েছিলেন, গাড়িতে তুলে তাদের চোখ বাঁধা হয়েছিল। তবে তুলে নেয়া আরেকজন ফারুক হাসান জানিয়েছেন, চোখ বাঁধার কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার ফারুক হাসান সংবাদভিত্তিক বেসরকারি প্রচারমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের বিশেষ সংবাদ এডিটরস পিকে অংশ নিয়ে জানান, তাদেরকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়ার কথা সত্য নয়।ফারুক হাসান বলেন, তাদের চোখ বাঁধা হয়নি, এটা নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।

সঞ্চালক খালেদ মুহিউদ্দিন একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে ফারুকের কাছে জানতে চেয়েছেন। আহ্বান জানিয়েছেন নির্ভয়ে বলার। তবে ফারুক বারবারই একই কথা বলেছেন, চোখ বাঁধা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।

সঞ্চালক বলেন, ‘চোখ বাধাটা কি ঠিক?’

জবাবে কোটা আন্দোলনের নেতা বলেন, ‘চোখ বাঁধার ব্যাপারটা, ওইভাবে চোখ বাঁধা হয়নি। তবে যে প্রসেসটা অ্যাপ্লাই করে আমাদের নিয়ে গেছে, প্রসেসটা একটু আলাদা টাইপের ছিল।’

এরপর ডিবি কার্যালয়ে অবস্থানকালে কী হয়েছে সেটি বর্ণনা করেন ফারুক হাসান। আর এরপর আবারও খালেদ মুহিউদ্দিন চোখ বাঁধার বিষয়টি জানতে চান।

-‘আপনাদের কি চোখ বাঁধা হয়েছিল?’

-‘চোখ আসলে ওভাবে বাঁধা হয়নি। আমাদেরকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি বারবার বলেছি, আপনাদের যদি কোনো জিজ্ঞাসাবাদ বা কোনো ধরনের সহযোগিতা দরকার, আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। সুতরাং আমাদের বললেই আমরা চলে যেতাম। সুতরাং এখানে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে।’

-‘আপনাদেরকে অতর্কিতে আটক করা হয়েছে, তাই তো? আপনাদের মূল অভিযোগ হয়েছে এটা? আপনাদের প্রস্তুতি ছিল না, বা আপনাদেরকে কিছু বলাও হয়নি?’

-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদেরকে আগে থেকে কিছু বলা হয়নি। আমাদেরকে ওইভাবে ইনফর্ম করা হয়নি।’

-কিন্তু চোখ বাঁধা হয়নি, এটা আপননি বলছেন?’

-‘চোখ আসলে ওভাবে বাঁধা হয়নি। আসলে চোখ বেঁধে অপরাধীকে যেভাবে নিয়ে যায়, ওভাবে নিয়ে যাওয়া হয়নি।’

-‘আপনি নির্ভয়ে বলেন, কীভাবে বাঁধা হয়েছে বলেন।’

-‘চোখ বাঁধা হয়নি ওভাবে।’

‘এখানে একটি ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল, যখন আমাদেরকে ডিবি কার্যালয় নেয়া হলো, তখন আমাদের বলা হলো আমাদের কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখানো ও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছে। আমি সেখানে বললাম আমাদেরকে আপনারা বললেই বা ফোন করলেই চলে আসতাম। কিন্তু আপনারা আমাদের যেভাবে নিয়ে এসেছেন, সেভাবে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি।

ডিবি কার্যালয়ে কী ধরনের তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে, সেটাও জানান ফারুক। বলেন, ‘আমাদের ওখানে বলা হয়েছে, ভিসির বাসভবনে যেভাবে ন্যাক্কারজনক হামলা চালানো হয়েছে, এ রকম কিছু ভিডিও ফুটেজ আমরা দেখাব, সহযোগিতা করেন আসলে রিয়েল কালপ্রিট কারা। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু পরে বলা হলো, ঠিক আছে আজকে আপনারা চলে যান, অন্য সময় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হবে।’

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে তুমুল আন্দোলনের মুখে গত ১২ এপ্রিল ‘কোনো কোটা থাকার দরকার নেই’ বলে সংসদে মত দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এরপর ছাত্ররা রাজপথ থেকে উঠে যায়।

এর মধ্যে কোটা আন্দোলনের চার নেতা হাসান আল মামুন, রাশেদ খাঁন, ফারুক হাসান এবং নুরুল ইসলাম নুরের শিবির সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় একটি জাতীয় দৈনিকে। অবশ্য সোমবার এই প্রতিবেদন আসার পর কোটা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠনটির পক্ষ থেকে সংবাদটি প্রত্যাহারের দাবিতে ওই দৈনিকটিকে বর্জনের ঘোষণা আসে এবং দৈনিকটি সংবাদটি তুলে নেয়।

তবে সোমবারই দুপুরে রাশেদ খাঁন, ফারুক হাসান এবং নুরুল ইসলাম নুরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ নিয়ে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠার মধ্যেই তিন নেতা ফিরে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

পরে সংবাদ সম্মেলনে তিন জন জানান, তাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল গোয়েন্দা পুলিশ এবং ঘণ্টাখানেক কথা বলে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। এই তিন জনই কোটা আন্দোলনে যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্বি পালন করেন।

ওই সংবাদ সম্মেলনে নুরুল হক নুর তাদেরকে তুলে নেয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমরা মেডিকেলে ভর্তি শিক্ষার্থীদের দেখে যাওয়ার সময় জরুরি বিভাগের সামনে থেকে ৩/৪টি মোটর সাইকেল এবং দুটো কালো কাচওয়ালা মাইক্রোবাস সেখানে আসে। রিকশা থামিয়ে টানা-হেঁচড়া করে তারা আমাদের মাইক্রোবাসে তুলে ফেলে।’

নূর আরও জানান, মাইক্রোবাসে তোলার পর প্রথমে তাদের হেলমেট পরিয়ে দেওয়া হয়। পরে গুলিস্তান এলাকায় নিয়ে গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। আর গাড়ি থেকে নামিয়ে চোখ খোলার পর তারা বুঝতে পারেন, তারা গোয়েন্দা কার্যালয়ে আছেন।

তবে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের চোখ বেঁধে আনার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, এমন কিছুই হয়নি।

বাতেন বলেন, ‘চোখ বাঁধা হয়নি, ভুল বোঝাবুঝি ছিল। তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও অভিযোগ নেই।’ পরে একই কথা বলেন তুলে নেয়া তিন জনের একজন ফারুক হাসান।

ফারুকের চোখ বাঁধার কথা অস্বীকার করার বিষয়ে জানতে চাইলে এই অভিযোগ তোলা নুরুল ইসলাম নুর তার দাবিতে অটল আছেন। ঢাকাটাইমসকে নুর বলেন, ‘আমাদের চোখ বেঁধে নিয়েছে এটা সত্য। সে হয়ত ভয়ে এ কথা বলেছে। কাল তো আমরা ইনস্ট্যান্ট সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। এর মধ্যে আমাদের ফোনে অনেকে অনেক রকম হুমকি দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হয়ত সে (ফারুক হাসান) এ কথাটা বলেছে।’

তবে কোটা আন্দোলনের নেতা ফারুক হাসানের কাছে ইনডিপেনডেন্ট টিভির অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হুমকি পাওয়ার বিষয়টি নিয়েও জানতে চান। জবাবে ফারুক বলেন, তারা কোনো ধরনের হুমকি পাননি।

খালেদ মুহিউদ্দিন জানতে চান, ‘আপনারা যারা আন্দোলন করছেন, তারা কি কোনো ধরনের হুমকি পাচ্ছেন?’

জবাব আসে, ‘না, না, আমরা এ পর্যন্ত কোনো ধরনের হুমকি বা কোনো কিছুই পাইনি। আমাদের আন্দোলন হচ্ছে ন্যায়ের পক্ষে। আমাদের আন্দোলন ছিল ৪৭ বছর ধরে সারা বাংলার ছাত্র সমাজের যে একটা দাবি…আমাদের দাবি আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপন করেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা যা চেয়েছি, তার থেকে বেশি আমাদের দিয়েছেন। সুতরাং এখানে কোনো রকম হুমকি বা কোনো কিছু আমরা এ পর্যন্ত পাইনি।’

এর আগে কোটা আন্দোলনের আরেক নেতা রাশেদ খাঁন আগের রাতে বেসরকারি টেলিভিশন একাত্তরের এক অনুষ্ঠানে সরাসরি যুক্ত হয়ে বিব্রতর অবস্থানে পড়েন। ২০১৩ সালে তার নারী অধিকারবিরোধী পোস্ট এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে আপত্তিকর পোস্ট নেয়ার বিষয়ে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি রাশেদ খাঁন। এক পর্যায়ে তিনি দাবি করেন, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছিল। কিন্তু বারবার একজনের আইডি হ্যাক হয় কি না, এমন প্রশ্নেরও জবাব দিতে না পেরে তিনি অপ্রস্তুত হয়ে যান।

ঢাকাটাইমস/১৭এপ্রিল/ডব্লিউবি