ছাত্রলীগের ন্যায় পল্টি মারলেন জাফর ইকবালও!

দু’দিন আগে সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় নেমে তাদের ন্যয্য দাবির পক্ষে সোচ্চার হলো। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মত করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জাফর ইকবালও কোটা সংস্কার ও আন্দোলনকারীদের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই দাবি এবং আন্দোলন যৌক্তিক।

তবে প্রধানমন্ত্রীর কোটা পদ্ধতি বাতিল সংক্রান্ত এক ক্ষুব্ধ বক্তব্যের পর কোটা সংস্কার আন্দোলন স্থগিত হওয়ার সাথে সাথেই জাফর ইকবালের গনেশও উল্টে গেলো। তিনি এখন বলছেন, কোটা আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে তিনি ভুল করেছিলেন। পাশাপাশি আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সমালোচনাও করেছেন তিনি।

ঠিক যেমনভাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের চরম বিরোধীতা ও প্রতিরোধকারী, শিক্ষার্থীদের উপর নগ্ন হামলাকারী, ছাত্রীর পায়ের রগ কর্তনকারী ছাত্রলীগও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর পরই পুরো উল্টে গিয়ে বললো, ‘আগে থেকে আমরা আন্দোলনে ছিলাম। এখনো আছি। আমরা আগে ছাত্র পরে লীগ।’ ছাত্রলীগ ও জাফর ইকবালের এই পল্টিবাজি যেনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রচলিত এরশাদের পল্টিবাজিকেও হার মানালো।

এদিকে ছাত্রলীগের পল্টিবাজিকে ছাত্রসমাজ স্বাভাবিক হিসেবে দেখলেও জাফর ইকবালের এমন পল্টিবাজিকে তারা মেনে নিতে পারছে না। তারা বলছেন, জাফর ইকবালকে অনেকে তরুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় একজন শিক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করলেও তা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হলো। তরুণ প্রজন্মের আশা আকাঙ্খা ও যৌক্তিক আন্দোলনকে যিনি প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেন তিনি আর যাই হোক তরুন প্রজন্মের কাছে প্রিয় কেউ হতে পারেন না।

গত ৯ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে জাফর ইকবালকে সাংবাদিকরা কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোটা সংস্কারের পক্ষে মত দেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দেখুন: মুক্তিযোদ্ধা কোটা ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ রাখার পক্ষে জাফর ইকবাল (বিডিনিউজ), কোটা সংস্কার প্রয়োজন: জাফর ইকবাল (বাংলাট্রিবিউন)।

১১ এপ্রিল সংসদে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের তীব্র সমালোচনার এক পর্যায়ে ক্ষোভের সঙ্গে ঘোষণা দেন ‘কোটারই দরকার নেই’। সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে কোটা সংস্কারে সমর্থন দেয়া সেখানকার অধ্যাপকদেরও তীব্র সমালোচনা করেন। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রী আনিসুজ্জামান ও জাফর ইকবালেরই সমালোচনা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সমালোচনার কারণেই নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে একদিন পরই নিজের আগের অবস্থান থেকে সরে এলেন জাফর ইকবাল।

বৃহস্পতিবার (১২ এপ্রিল) জাফর ইকবাল “দাবি, আন্দোলন ও আন্দোলনের প্রক্রিয়া” শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। এই লেখায় তিনি কোটা সংস্কার ইস্যুতে দেয়া তার আগের বক্তব্য বদলে নিয়েছেন। এবং একইসাথে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলেছেন। যেসব অমূলক অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও তোলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধানতমটি হচ্ছে- ঢাকা শহরে রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করা। অধ্যাপক ইকবালের মতে, এটি চরম অন্যায় কাজ হয়েছে। এবং এমনটি করা হবে জানলে কোটা সংস্কারের পক্ষে মন্তব্য করা থেকে তিনি একশ হাত দূরে থাকতেন। জাফর ইকবালের লেখার কিছু চুম্বক অংশ হুবহু তুলে ধরা হলো:

“পরদিন খবর পেলাম পুরো ঢাকা শহরকে ছেলেমেয়েরা অচল করে দিয়েছে। একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজেদের এলাকার রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে ফেলেছে। ঢাকা শহরের অবস্থা আমরা জানি, শহরের এক কোণায় কিছুক্ষণ ট্রাফিক বন্ধ থাকলেই কিছুক্ষণের মাঝে পুরো শহরে তার প্রভাব পড়ে। কাজেই শহরের বড় বড় ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা সবাই যদি নিজেদের এলাকাকে অচল করে রাখে, তার ফল কী ভয়াবহ হবে, সেটা চিন্তা করা যায় না। এই পদ্ধতিটি নতুন নয়, এর আগেও একবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা একই পদ্ধতিতে তাদের দাবি আদায় করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের সাত খুন মাপ, তারা যখন খুশি পুরো শহর, প্রয়োজন হলে পুরো দেশের মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে পারে, তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না।

তাদের এই কর্মকাণ্ডে যে শিশুটি স্কুলে যেতে পারেনি, যে রোগীটি হাসপাতালে যেতে পারেনি, গার্মেন্টেসের যে মেয়েটি কাজে যেতে পারেনি, যে রিকশাওয়ালা তার পরিবারের খাবার উপার্জন করতে পারেনি, তাদের কারও জন্য দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এই ছাত্রছাত্রীদের কোনও মায়া নেই। তারা দেশের মানুষকে জিম্মি করে, যারা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদেরও অপরাধী করে দিয়েছে। যদি আমি জানতাম, তারা এরকমটি করবে তাহলে তাদের দাবির বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে একশ হাত দূরে থাকতাম। বিসিএস পরীক্ষায় কী প্রশ্ন করা হয় কিংবা ভাইভায় কী জিজ্ঞেস করা হয়, আমি জানি না। আমি যদি সেই পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্বে থাকতাম, তাহলে তাদের নিচের প্রশ্নটি করতাম:

তোমার দাবি আদায় করার জন্যে তুমি কী সবাইকে নিয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে পুরো শহরকে জিম্মি করে ফেলার বিষয়টি সমর্থন করো? যারা এই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি নেওয়ার স্বপ্ন দেখছে তারা কী উত্তর দিতো? আমার খুব এটি জানার ইচ্ছা।”

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এইসব অভিযোগ তুলতে গিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবাল তার আগের আরেকটি অবস্থান থেকে শতভাগ উল্টে গেছেন। ২০১৩ সালে শাহবাগে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে আয়োজিত এক সমাবেশে জাফর ইকবাল ছাত্র সমাজকে ‘যখন দরকার’ রাস্তায় নেমে আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

এবার দেখুন এই ভিডিওতে ২০১৩ সালে দীর্ঘদিন ধরে শাহবাগ-কাটাবন-পরিবাগ-মৎস ভবন মোড় অবরোধ করে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে কী বলেছিলে অধ্যাপক জাফর ইকবাল।

জাফর ইকবাল সেদিন তার বক্তব্যে বলেছিলেন, “আমি পত্রিকায় লিখেছি যে, এই নতুন জেনারেশন খালি ফেসবুকে লাইক দেয়, এরা আর কিছু করে না। আমি লিখেছি এরা খালি ব্লগ করে, এর আর কিছু করে না। এরা রাস্তায় নামে না। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছো। এই দেখো, এখানে ব্লগাররা আছে, এই ব্লগাররা সারাদিন পৃথিবীতে যেটা হয় নাই এটা এখানে ঘটিয়ে দিয়েছে। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই, আমাকে ক্ষমা করে দিও সবাই। আজকের মতো আনন্দের দিন আমি আমার জীবনে কোনো দিন পাই নাই। …. তোমাদেরকে আমি অনুরোধ করি, যখন লেখাপড়ার কথা তখন লেখাপড়া করবে। যখন গান গাওয়ার কথা তখন গান গাইবে। যখন কবিতা লিখার কথা, কবিতা লিখবে। ছবি আঁকার কথা, ছবি আঁকবে। ভাস্কর্য বসানোর কথা, ভাস্কর্য বসাবে। প্রেম করার কথা, প্রেম করবে। বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট দেশে তৈরি করবে। নোবেল প্রাইজ আনবে। যখন রাস্তায় নামার দরকার পড়বে, রাস্তায় নামবে। তোমাদের কাছে সারা বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ সবাইকে।”

যান চলাচলের ক্ষেত্রে ঢাকা শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর একটি শাহবাগ। সেখানে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা দীর্ঘদিন ধরে দখল করে সমাবেশে নিজে বক্তব্য দিয়েছেন জাফর ইকবাল। আবার সেই বক্তব্যে ছাত্র সমাজকে আহ্বান জানিয়েছেন এই বলে, “যখন রাস্তায় নামার দরকার পড়বে, রাস্তায় নামবে।”

আজ কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছে ছাত্র সমাজ। তারা তাদের শিক্ষকতুল্য প্রিয় জাফর ইকবালের আগের নির্দেশ মতোই যখন দরকার মনে করেছে রাস্তায় নেমেছে। অথচ এক্ষেত্রে ন্যয্য দাবিতে আন্দোলনকারীদের অভিযুক্ত করলেন তিনি। কারন এই আন্দোলনের পক্ষে ছিলো না সরকার। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ এই আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালিয়েছে। সরকারপ্রধান আন্দোলনকারীদের তীব্র সমালোচনা করেছে। সুতরাং নীতি নৈতিকতার মাথা খেয়ে এখন জাফর স্যারকেও এই আন্দোলনের বিরোধীতাই করতে হবে। কারন স্যার এই সরকারের সেবাদাস, একনিষ্ঠ সমর্থক। এমন স্যারদের ধিক্কার জানায় ছাত্রসমাজ।