২০ দলে আস্থার সংকট

এখনই আসন ভাগাভাগি নিয়ে জোটের শরিকদের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বেড়েছে। বিএনপির চলমান দুঃসময়কে হিস্যা আদায়ের মোক্ষম সময় হিসেবে বেছে নিয়েছে শরিকরা। দুর্দিন চলে গেলে প্রত্যাশা অনুযায়ী, প্রাপ্তি হবে না বলেও মনে করছেন তারা। অন্যদিকে শরিকদের পাহাড় সমান আবদার পূরণ করা সম্ভব নয় এবং এখনই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিলেও শরিকদের সন্তুষ্ট করা যাবে না- এমন বিবেচনায় কৌশলে সময় ক্ষেপণ করছে বিএনপি। ফলে চরম আস্থার সংকট চলছে ২০ দলে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০-দলীয় জোটের বিএনপির শরিক দলগুলো বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। এখনই নির্বাচনে তাদের অবস্থান কি হবে এবং কত আসন ছাড় পাবে, সেটা বিএনপির কাছে জানতে চেয়েছে। অনেক দল প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত্ম করে এরই মধ্যে বিএনপির কাছে দিয়ে দিয়েছে। আদালতের রায়ে নিবন্ধন হারানো জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন কৌশলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্ত্মতি নিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ভাবছে দলটি। জামায়াতসহ জোটের ছোট-বড় বাকি দলগুলো বিএনপির কাছে প্রায় ১৫০ আসনে ছাড়ের দাবি করছে। পাশাপাশি প্রত্যাশা পূরণ না হলে অন্য জোটে যোগদান বা একা নির্বাচন করার হুমকিও দিচ্ছে।

সূত্রমতে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের বিষয়ে জোটের প্রায় সব নেতারা আন্ত্মরিকতা দেখিয়েছেন। মুক্তির বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না বলেও জোটের প্রতিটি বৈঠকে নেতারা শপথও নিয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি আসন ছাড় নিয়ে বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে শরিকরা। বিশেষ করে আন্দোলন কর্মসূচিতে জোট নেতারা যাথাযথ মূল্যায়ন না পাওয়া এবং সম্প্রতি জোটের এক শীর্ষ নেতা বিএনপির কার্যালয়ে গিয়ে প্রত্যাশা অনুযায়ী সম্মান না পাওয়ায় এই তৎপরতা আরও বেড়েছে।

এর অংশহিসেবে জোটের শরিক দলগুলো অনেক সময় বিএনপি নেতাদের নিয়ে আবার অনেক সময় বিএনপি নেতাদের ছাড়া প্রকাশ্যে এবং গোপনে বৈঠকও করছে। সম্প্রতি রাজধানীতে ২০ দলের অন্যতম শরিক এলডিপির ঢাকা মহানগর (উত্তর) শাখার সম্মেলনে জোটের শরিক নেতারা আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে এখনই ফয়সালা করার দাবি তোলেন। ওই সম্মেলনে জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা উপস্থিত থাকলেও মূল দল বিএনপির কেউ উপস্থিত ছিলেন না। সম্মেলনে এখনই আসন ছাড় নিয়ে বিএনপির প্রতি ‘কঠোর বার্তা’ ছুড়ে দেন শরিকরা। জানানো হয়, ৩০০ আসনে ৬০০ প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। এ ছাড়া ঘরোয়া বৈঠকগুলোতেও কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগেই আসন ভাগের ফয়সালা করতে বিএনপি নেতাদের চাপ দেয়া অব্যাহত রেখেছে শরিকরা।


সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নির্বাচনে যেতে ক্ষমতাসীনদের কাছে কি ধরনের প্রস্ত্মাব পেয়েছিল, সেসব বিষয় বিএনপিকে শরিকরা জানাচ্ছেন। কেউ বলছেন, ১০টি আসন, একজন মন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রী পাওয়ার প্রস্ত্মাব পেয়েও ২০ দল ছেড়ে যায়নি। আরেকটি দল বলছে, তাদের দেয়া হয়েছিল ছয়টি আসনে ছাড়। বলতে গেলে ২০ দলের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের কাছে নানা ধরনের প্রস্ত্মাব এসেছিল বলে বিএনপি নেতাদের জানাচ্ছেন। পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে বিএনপি কাকে কয়টা আসনের ছাড় দেবে, সেটা এখনই সিদ্ধান্ত্ম নেয়ার কথা বলছেন। বিএনপি নির্বাচনের আগে এই সমস্যার সমাধান করে দেয়ার আশ্বাস দিলেও এতে কাজ হচ্ছে না।
শরিক দলের সিনিয়র এক নেতা জানান, শুধু বিএনপির আশায় তারা বসে নেই। অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গেও অনেকের কথা হচ্ছে। আবার জোটের সঙ্গে নির্বাচনের পাশাপাশি এককভাবে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রাখছে। পাশাপাশি আন্ত্মর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছেন। চলতি মাসের মধ্যে আসন ছাড় নিয়ে বিএনপি সন্ত্মোষজনক কোনো প্রস্ত্মাব না দিলে নতুন করে ভাবার কথাও জানান এই নেতা। তার দাবি, বিএনপির সময় পরিবর্তন হলে শরিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করবে না। এ জন্য এখনই আসনের হিস্যা বুঝে নিতে চায় তারা।


রাজনৈতিক মহলে ২০-দলীয় জোটে ভাঙনের আলোচনার বিষয়ে এই নেতা আরও বলেন, আসন ভাগাভাগি নিয়ে মনোমালিন্য হলেও আপাতত জোটের ভাঙন হয়ত দেখা দিবে না। ভাঙনের বিষয়টি নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার মুক্তির ধরনের ওপর। খালেদা জিয়ার মুক্তির ধরনই বলে দিবে আগামীর রাজনীতিটা কাদের পক্ষে মোড় নিচ্ছে। সম্মানজনকভাবে খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে জোট শুধু টিকবেই না, বরং নতুন করে আরও দল জোটে যোগ দিবে। আর খালেদা জিয়ার মুক্তির ধরন যদি সম্মানজনক না হয়, সে ক্ষেত্রে জোটের শরিকদের আসন ছাড় প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হলেও জোটের ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। এ জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জোটের সঙ্গে দরকষাকষি নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে আগে থেকেই সমঝোতায় আসা উচিত বিএনপির। যাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির জন্য শক্তি নিয়ে কাজ করা যায়।
সূত্রমতে, আসন ছাড়ের বিষয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোই বেশি চাপ দিচ্ছে বিএনপিকে। এই ইসু্যতে অনিবন্ধিতদের দূরে রাখতে চাচ্ছে তারা। ফলে শরিকদের মধ্যেও এক ধরনের বিভক্তি দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার জোটের বৈঠকে নিবন্ধিত দলগুলো আসন ছাড় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু অনিবন্ধিত দলগুলোর উপস্থিতির কারণে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো দ্রম্নত সময়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে বসার তাগিদ দিয়েছে বিএনপিকে।


বিএনপি সূত্রগুলো বলছে, বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলে এখনই আসন ভাগের জন্য শরিকরা চাপ দিচ্ছে। সময়ের সুযোগে পাহাড় সমান আবদার করছে। পরিকল্পনা করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসনের বিষয়ে এখনি নিষ্পত্তি চাচ্ছে। তবে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকার সময় এই ইসু্যতে চূড়ান্ত্ম কোনো সিদ্ধান্ত্ম নেয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া শরিকদের দাবি এতই বেশি যে, জোট ভেঙে গেলেও তাদের দাবি পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ, এমন অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যাদের ১০টি জেলায় কমিটি নেই। তারা ২০-৩০ আসন দাবি করছে। এ বিষয়ে বিএনপির চূড়ান্ত্ম সিদ্ধান্ত্ম হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় এবং সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি হলে ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিকদের সঙ্গে জোটগত নির্বাচন ও আসন বন্টন নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এখনই আসন বন্টন নিয়ে শরিকদের দরকষাকষির বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, এখনই আসন ভাগাভাগির দাবিতে কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন। তবে রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক নয়। জোটের শরিক দলগুলো ‘সুযোগ নিচ্ছে’। এর পেছনে সরকারের মদদও থাকে। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে ২০-দলের নির্বাচনে না যাওয়া, শান্ত্মিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জোট একমত হয়েছে। জোটের জন্য বিএনপির একজনকে সমন্বয়কারী করা হয়েছে। তাই মনে করি না যে, জোট ভাঙার মতো অ
জোট ভাঙা এবং আসন নিয়ে দরকষাকষির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত বস্থা হয়েছে। হয়ত তারা তাদের হিসাব-নিকাশ বুঝে নিতে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে।হলেও এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রম্নহুল কবির রিজভী বলেন, জোটে কোনো সমস্যা নেই। বিএনপি জোটবদ্ধভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে।

একই বিষয়ে এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে কর্নেল অলি মন্ত্রীসহ অনেকেই এমপি হতে পারতেন। তখন তিনি সরকারের কোনো প্রলোভনে পা দেননি। এ বিষয়টি বিএনপিকে মনে রাখতে হবে। বিএনপিকে জোটের শরিক দলগুলোকে মর্যাদা দিতে হবে। আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের জন্যও তৈরি থাকতে হবে। বিএনপি এসব বিষয় বিবেচনা করবে- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আসন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হলেও জোট ভাঙবে না।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব এম. গোলাম মোস্ত্মাফা ভুইয়া বলেন, জোট রাজনীতিতে অনিশ্চয়তার বিষয় সব সময়ই থাকে। এ জন্য দলের একটি প্রার্থী তালিকা তৈরি করা হয়েছে। একক নির্বাচনের প্রস্তুতিও রাখা হচ্ছে। সূত্র : যায়যায়দিন