হিরো আলমের মার খাওয়া: দুর্ভিক্ষ রুচির, নাকি মস্তিষ্কে?

আমিনুল ইসলাম: একজন সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে রাস্তায় ফেলে একদল মানুষ মারছে। তিনি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।একজন সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে রাস্তায় ফেলে একদল মানুষ মারছে। তিনি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।ছবি : প্রথম আলো

ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন হয়ে গিয়েছে এবং এর মধ্যেই সরকারদলীয় প্রার্থীর বিজয়ের সংবাদ দেশের মানুষ জানতে পেরেছে। এই নির্বাচনে বেশ কয়েকজন প্রার্থী ছিলেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম (হিরো আলম) এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মাদ আলী আরাফাতই মূলত আলোচিত হয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আলোচনায় থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী কে এই হিরো আলম?

যতটুকু জানা যায়, হিরো আলম বগুড়ায় কেব্‌ল নেটওয়ার্কের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তখন থেকেই তিনি ছোটখাটো ভিডিও বানিয়ে এলাকার কেব্‌ল নেটওয়ার্কে মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশে নানাভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি কখনো রাজনীতি করেছেন? কিংবা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন?

যতটুকু জানা যায়, হিরো আলম সেই অর্থে কখনোই মাঠপর্যায়ে রাজনীতি করেননি। এর আগে কখনোই তাঁকে দেশ ও সমাজ নিয়ে ভাবতে দেখা যায়নি। কখনোই কোনো মিছিল-মিটিংয়ে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়নি। অথচ এর মধ্যেই তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে গিয়েছেন। তিনি বগুড়ার উপনির্বাচনে জিততে জিততে হেরে গিয়েছেন খুব অল্প ভোটে; যদিও তিনি নিজে দাবি করেছিলেন, তাঁকে হারানো হয়েছে।

সেই হিরো আলম যখন ঢাকার গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় নির্বাচন করার জন্য প্রার্থী হলেন, তখন এ নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করেছে। অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। অথচ নির্বাচনের দিন আমরা কী দেখলাম?

এই যে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে; সাধারণ মানুষের মনে ধারণা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি করেন দেশে আর বেগমপাড়া বানান ইউরোপ-আমেরিকায়। এ ধারণার সৃষ্টি কোথা থেকে? এসব কি আপনারা ভেবে দেখেছেন? নইলে হিরো আলমের মতো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গেও কেন আপনাদের মারামারি করতে হয়? আপনারা কি ভেবে দেখেছেন, দুর্ভিক্ষটা আসলে রুচির, নাকি জনপ্রিয়তার?

একজন সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীকে রাস্তায় ফেলে একদল মানুষ মারছে। তিনি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। কে বা কারা মেরেছে, সে প্রশ্নে যেতে চাইছি না। সেখানে তো অনেক পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের কাজটা আসলে কী? সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীর কথা বাদই দিলাম। দেশের একজন সাধারণ মানুষও যদি আক্রান্ত হয়, তার জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তাহলে তারা কেন এগিয়ে এল না?

এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? আর হিরো আলমের মতো একজন মানুষ, যাঁর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, তাঁকে সামলাতেই যদি একটি বড় রাজনৈতিক দলের এ অবস্থা হয়, তাহলে কিছু প্রশ্ন বোধ করি থেকেই যায়। আপনারা তো বলে থাকেন, দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে, আপনাদের জনপ্রিয়তা অনেক, তাহলে কেন একজন প্রার্থীকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে মারতে হচ্ছে? কেন একটা নির্বাচনে মাত্র সাড়ে ১১ শতাংশ ভোট পড়ে? আপনাদের কর্মী-সমর্থক কিংবা জনপ্রিয়তা তখন কোথায় থাকে?

দেশে গত এক দশকে বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে—এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে নির্বাচনের সময় কেন এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব?

এরপরই মনে হয় সুশাসন আর দুর্নীতির কথা। এই যে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে; সাধারণ মানুষের মনে ধারণা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি করেন দেশে আর বেগমপাড়া বানান ইউরোপ-আমেরিকায়। এ ধারণার সৃষ্টি কোথা থেকে? এসব কি আপনারা ভেবে দেখেছেন? নইলে হিরো আলমের মতো একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সঙ্গেও কেন আপনাদের মারামারি করতে হয়? আপনারা কি ভেবে দেখেছেন, দুর্ভিক্ষটা আসলে রুচির, নাকি জনপ্রিয়তার?

দেশের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অনেকেই অবশ্য এখানে অরুচিকর কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন মানুষকে প্রকাশ্যে গালাগালি করে রাস্তায় ফেলে মারলেও তাঁদের মনে হয় না, এটি অরুচিকর কাজ কিংবা রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।

এখন বোধ করি ভেবে দেখার সময় এসেছে—দুর্ভিক্ষটা কি আদৌ রুচির, জনপ্রিয়তার, নাকি মস্তিষ্কে!

ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।