শেখ হাসিনার অধীনে আরেকটি নির্বাচনে বিরোধী জোটকে অংশগ্রহণ করানো হচ্ছে তাদের মিশন

অলিউল্লাহ নোমান: পত্রিকা খুললেই ইদানিং “সংলাপ” নিয়ে তাগিদ দেখতে পাই। বিশেষ করে ইন্ডিয়াপন্থি প্রথম আলো’র সংলাপের তাগিদ দেখে বিস্মিত হই। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে “ঐক্যের প্রতীক” ড. কামাল হোসেনও সংলাপের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। আওয়ামী মিডিয়া গুলোর তথ্য সন্ত্রাসী সাংবাদিকরাও কথায় কথায় রাজনৈতিক নেতাদের প্রশ্ন করেন সংলাপ হবে কি না। সবই যে একটি ছকে চলছে সেটা বোঝা যায়, ইন্ডিয়াপন্থি প্রথম আলো, ড. কামাল ও আওয়ামী মিডিয়া সন্ত্রাসীদের সংলাপ নিয়ে ব্যস্ততা দেখলে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে “সফল” সংলাপ হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে। অতীতে আর কোন সংলাপ সফলতার মুখ দেখেনি। তাই কথিত সফল সংলাপটি দিয়েই শুরু করি।

ড. কামাল হোসেনের সংলাপের আহ্বান দেখে চোখের সামনে ভেসে উঠে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের চিত্র। নিকট অতীতের ঘটনা। সবারই স্মরণে আছে নিশ্চয়ই। তাঁর ইমামতিতে জোট গঠনের ঘোষণার পরপরই সংলাপের আহ্বান জানিয়ে তাঁরই এক সময়ের নেত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিলেন। চিঠি পেয়ে কাল বিলম্ব করেননি শেখ হাসিনা। বিদ্যুৎ গতিতে পাল্টা চিঠিতে সংলাপের আহ্বান কবুল করলেন। ড. কামাল হোসেনের ইমামতিতে জোটের শরীক দল গুলোর নেতারা সকলে মহা আয়োজনে গেলেন গণভবনে। তাও আবার একবার নয়। দুইবার গেছেন গণভবনে শেখ হাসিনার সাথে সংলাপ করতে। নি:শর্ত সংলাপে খানাপিনার পাশাপাশি কুশল বিনিময় হয়েছিল। জোটের শরীক দল হিসাবে বিএনপি নেতৃবৃন্দ তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রসঙ্গ উঠালেন। শেখ হাসিনা অত্যন্ত দরদের সাথে তাদের বলেছিলেন মামলার লিস্ট তাঁকে দিতে। নেতারা হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় গণভবন থেকে বের হয়েই নিজেদের মামলার তালিকার জন্য সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে তাগিদ দিলেন। রাতদিন খেটে দ্বিতীয় দফা সংলাপের আগে যোগদানকারী নেতাদের নামে দায়ের হওয়া মামলা গুলোর তালিকা তৈরি করে দিলেন। পরবর্তীতে দেখা গেল ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর এই মামলা গুলো নিষ্পত্তির তাগিদ সংশ্লিষ্ট আদালত গুলোতে। মামলার এই তথ্যটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে আমাদের জানা থাকা দরকার নেতারা সংলাপে গিয়ে জাতীয় স্বার্থ ভুলে নিজেদের মামলা প্রত্যাহারের তদবিরে ব্যস্ত হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনার সাথে সংলাপ পরবর্তী নির্বাচনী পরিবেশ ও নির্বাচনের ফলাফল সকলেরই জানা। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে শুনতে পেয়েছিলাম পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হবে। সেই আশ্বাসের পরপরই ঘটা করে সংলাপে যোগদান ও নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা। এই আশ্বাসে ভর করেই জোটের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোটের দিন দুপুরে বলেছিলেন ভোট সুন্দর এবং সুষ্ঠু হচ্ছে। জোটের ইমাম ড. কামাল হোসেনও একই কথা বলেছিলেন। অনেক নেতা বড় টিভি পর্দায় ফলাফল দেখার জন্য টিম গঠন করেছিলেন। কারা তাঁর সঙ্গে ফলাফল দেখায় উপস্থিত থাকবেন সেই মোতাবেক আয়োজন করা হয়েছিল। বড় টিভি পর্দায় নেতার সাথে ফলাফল দেখার দুর্লভ সুযোগ পেয়ে অনেককে আনন্দে আত্মহারা হতেও দেখেছি। শেষ বেলায় মাত্র ৬টি সীট নিয়ে রাতে ঘরে ফিরলেন সবাই।

গত নির্বাচনের আগে ভারত গোপনে আশ্বাস দিয়েছিল। এবার অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছেন তারা পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর একক কোন রাজনৈতিক দলের সাথে নয়, সকল রাজনৈতিক দলের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করের এই বক্তব্যকে অনেক নেতা ইতিবাচক হিসাবেই দেখছেন। এতে ভারতের সফলতা নিয়ে আরেক দিন আলোচনা করা যাবে। আজকে সংলাপের মধ্যেই থাকতে চাই।

সংক্ষেপে শুধু বলে রাখি, শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন ভারতকে যা দিয়েছেন সারা জীবন মনে রাখতে হবে। ভারত সকল রাজনৈতিক দলের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার ফলাফল হচ্ছে, শেখ হাসিনা ভারতের কাছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার পরও একটি শব্দে কোন প্রতিবাদ নেই। বন্দর, ট্রানজিটের নামে করিডোর থেকে শুরু করে সবই দেওয়া হয়েছে। এবার বাণিজ্য হবে ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মূদ্রায়। ভারতীয় রূপিও বাংলাদেশের মূদ্রাবাজার দখল করবে। নেপালের মত দোকানে দোকানে ভারতীয় মূদ্রায় কেনাকাটা হতেও হয়ত বেশি দেরি হবে না। সুতরাং ভারত যেহেতু একটি রাজনৈতিক দলের সাথে নয়, সকলের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তাই প্রতিবাদ থেকে বিরত সবাই। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গুলো নাকি ভারতের সফলতা সেটা একটু ভাববার বিষয়।

ফিরে আসি সংলাপে। ১৯৭০ সালের ভোটের পর পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া এবং তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে বিজয়ী দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের লম্বা সংলাপ হয়েছিল। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে এই সংলাপ সফল না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। সংলাপ সফল হলে ইতিহাস অন্যরকম হত। মূলত সংলাপে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকদের আগ্রাসী আচরণে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল পাকিস্তান আর্মিতে থাকা বাঙ্গালীদের বিদ্রোহ। সামরিক শক্তিই এগিয়ে নিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে।

১৯৯৫ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলো জঙ্গি আন্দোলন করেছিল। আগুণ সন্ত্রাস, দিগম্বর সন্ত্রাস, সচিবালয়ের গেইটে মানব বিষ্ঠা ছিটানো সন্ত্রাস সবই তখন দেখেছে দেশের মানুষ। তখন রাজনৈতিক সঙ্কট মিটাতে সংলাপের আমন্ত্রণ নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসাবে এসেছিলেন স্যার নিনিয়ান। তিনি ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অবস্থান করে টানা সংলাপ করেছেন তৎকালীন সরকারে থাকা বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে। সফলতার মুখ দেখেনি সংলাপ। রীতিমত বিফল হয়ে ফেরত গেলেন নিনিয়ান। পর্দার আড়ালে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম ক্যূ করার প্রস্তুতি নেওয়ার পরই দ্রুত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল সাংবিধানিক সরকারের হাতে। যদিও বলা হয় সর্বশেষ ফয়সালা এসেছিল রাজপথ থেকে।

আবারো ২০০৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গি আন্দোলন শুরু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সংস্কারের দাবীতে। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিএনপি’র তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূইয়া এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল দিনের পর দিন জাতীয় সংসদ ভবনে একটি কক্ষে বসে ঘটা করে সংলাপে করেছিলেন। দুই মহাসচিবের সংলাপে কোন ফয়সালা আসেনি। শেষ দিন সংলাপ শেষে সংসদ ভবন থেকে গোপনে দুইজন দুই দিকে বের হয়ে গিয়েছিলেন সাংবাদিকদের এড়িয়ে।

পরবর্তীতে শেখ হাসিনার হুকুমে লগি-বৈঠার সন্ত্রাস দেখেছে দেশের মানুষ। শেষ বেলায় সেনাপ্রধানকে ব্যবহার করে ক্ষমতা নিয়েছিল আধিপত্যবাদী শক্তি। তাঁরই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিদায় নিতে হয় সেনাপ্রধান মঈনকে।

শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিলেন ২০১১ সালে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবীতে তুমুল গণ আন্দোলন হয়েছে। দেশ অচল হয়ে পড়েছিল গণমানুষের আন্দোলনে। কিন্তু ভারতের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপে দেশে নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছিল রীতিমত। ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামীরা বিজয়ী। এই নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকো এসেছিলেন সংলাপের মধ্যস্থতা করতে। তিনিও দিনের পর দিন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে বৈঠক করলেন। কিন্তু স্যার নিনিয়ানের মত তাঁকেও নিষ্ফল হয়ে ফিরতে হয়েছিল।

সংলাপ যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান এনে দিতে পারেনি সেটা এখন ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী। সুতরাং প্রথম আলো এবং আওয়ামী তথ্য সন্ত্রাসীরা জেনে বোঝেই ২০১৮ সালের মত আবারো তাদের মত করে “সফল” আরেকটি সংলাপের দিকে নিয়ে যেতে চায় দেশকে। মূলত শেখ হাসিনার অধীনেই আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং বিরোধী জোটকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করানোই হচ্ছে তাদের মূল মিশন।

লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক

উৎসঃ আমার দেশ