অন্যকে বাঁশ দিতে গেলে নিজেই বাঁশ খেতে হয়! ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত

দেখতে দেখতে তিন মাসেরও অধিককাল অতিক্রম করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। গত ৩ জুন এ যুদ্ধের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধের সঠিক কোনো গন্তব্য দেখছে না বিশ্ব। বলতে গেলে এ যুদ্ধের পরিণতি এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যেই রয়েছে। অনেকেই চিন্তা করেছিল, এ যুদ্ধ হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু যুদ্ধটি দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ফলে ইউরোপ এবং ইউরোপের বাইরে সমগ্র বিশ্বেই এর যে ধরনের পরিণতি বা প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেটা রীতিমতো একটি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করছে। দৃশ্যত যুদ্ধ করছে রাশিয়া ও ইউক্রেন পরস্পরের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধটি হচ্ছে ইউক্রেনের মাটিতে; কিন্তু যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে সারা বিশ্বে।

এ যুদ্ধে জড়িত দৃশ্যমান পক্ষগুলোর-রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের অনেক হিসাব-নিকাশই পালটে যাচ্ছে। এর একটি হচ্ছে, ইউক্রেন আক্রমণের পেছনে রাশিয়ার যে ধরনের কৌশলগত উদ্দেশ্য ছিল, সে উদ্দেশ্য হয়তো বা তারা কিছুটা অর্জন করলেও ইউক্রেনকে যেভাবে তারা পরাজিত করার কথা চিন্তা করেছিল, সেটা সম্ভব হয়নি। নাম থেকেই বোঝা যায়, এ যুদ্ধটি ছিল রাশিয়ার ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’। সাধারণত স্পেশাল অপারেশন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফলে এ যুদ্ধ যে এত দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা রাশিয়ার ভাবনার মধ্যে ছিল না। এ ধরনের একটি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে রাশিয়ার পুতিন সরকার হয়তো নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে এবং সেই কৌশলটি এখন পর্যন্ত তারা তাদের নিয়ন্ত্রণেই রাখতে পেরেছে।

ইউক্রেনের দিক থেকে বলা যায়, ইউক্রেনের আসলে প্রাপ্তি বলতে কিছু নেই। আমরা হয়তো রাশিয়ার ক্ষেত্রে বলতে পারি, এ যুদ্ধে রাশিয়ার এক ধরনের সামরিক শক্তি প্রদর্শন এবং এ অঞ্চলগুলোতে তাদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এ যুদ্ধের সূত্রপাত। ভবিষ্যতে এ যুদ্ধ কোনো না কোনো দিন শেষ হবে, কিন্তু এ অঞ্চলে রাশিয়ার সঙ্গে আচরণের দিক থেকে একটা পরিবর্তন আসতে পারে। এ পরিবর্তনটি হচ্ছে, একদিকে রাশিয়াকে অনেক বেশি সমীহ করা হবে, অন্যদিকে রাশিয়ার ব্যাপারে হয়তো বা অবিশ্বাস ও অনাস্থা বাড়বে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি হিসাবে রাশিয়ার অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত সেটা আমরা বলতে পারি।

এ যুদ্ধে সত্যিকারের ক্ষয়ক্ষতি বা মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য বা সম্পদের ক্ষতি সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা কোনো পক্ষই দিতে পারছে না। কেউ সেদিকে যাচ্ছেও না। আমরা দেখছি, মাঝে মাঝে ইউক্রেন ঘোষণা করছে যে এতজন রাশিয়ান সৈন্য মারা গেছে অথবা জাতিসংঘ যুদ্ধসংক্রান্ত বিভিন্ন পরিসংখ্যান ঘোষণা করছে। কিন্তু এসব তথ্য বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে একেবারেই সংগতিপূর্ণ নয়। এ রকম একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে যে যাচ্ছে, সেটা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। ইউক্রেনের অর্থনীতির ক্ষতির কথা বলা হয়, যার পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি হতে পারে। তবে যে যাই বলুক, আসলে যুদ্ধের প্রকৃত অবস্থা জানার তেমন কোনো সুযোগ নেই।

ইউক্রেনের বিষয়ে আমরা বলতে পারি, ইউক্রেন তার সামরিক কৌশল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ দুটিতেই এক ধরনের দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে। একটা পর্যায়ে দেখা যাবে, ইউক্রেনের নিরপেক্ষ থাকার যে সুযোগটি ছিল, সে সুযোগটি ত্যাগ করার ফলে যুদ্ধ বন্ধ হলেও সবসময় দেশটি রাশিয়ার চাপের মধ্যে থাকবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় ইউক্রেনকে কতটা সমর্থন দিয়ে যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইউক্রেনের ভেতরে এখন পর্যন্ত শঙ্কা রয়েই গেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে আমরা জানি, পুরো ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ, বিশেষ করে পূর্ব অঞ্চলটি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটি দীর্ঘস্থায়ীভাবে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

এ অঞ্চলে ইতোমধ্যে যারা বিদ্রোহী ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং ইউক্রেন থেকে যারা বেরিয়ে গেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে অঞ্চলটি। ফলে একদিকে ভূখণ্ডের দিক থেকে ইউক্রেনকে ছাড় দিতে হচ্ছে, অর্থাৎ তাদের মূল ভূখণ্ড থেকে একটা অঞ্চলকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে; অন্যদিকে ইউক্রেনের সার্বিক অর্থনীতি পর্যুদস্ত হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাদের নিরাপত্তা আরও বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। ফলে ইউক্রেনের কোনো প্রাপ্তি এ যুদ্ধে নেই। বরং ইউক্রেন এ যুদ্ধে একটি ভয়াবহ পরাজিত শক্তি হিসাবেই রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে আরও বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে দেশটি। ফলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ খুব একটা পরিষ্কার নয়।

এ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্বের প্রাপ্তি বলতে তেমন কিছুই নেই। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে এবং সেই চাপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দৃশ্যমান। সেসব দেশে মূল্যস্ফীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন আঙ্গিকেই এর প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু যে ক্ষতিটি পশ্চিমা বিশ্বের অনেক বেশি মাত্রায় হয়েছে, সেটি হচ্ছে রাশিয়ার মতো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রকে স্থায়ীভাবে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে বৈরী পরিবেশ তৈরি করা। এটি পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে। রাশিয়া এমন একটি রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তির অধিকারী।

ভৌগোলিক দিক থেকে আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ রাষ্ট্র এবং একটি বিশাল জনসংখ্যাও আছে দেশটিতে। সুতরাং এ রকম একটি রাষ্ট্রকে স্থায়ীভাবে শত্রু হিসাবে বা হুমকি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং এক ধরনের চির শত্রুতার পরিবেশ তৈরি করা কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক হতে পারে না, বরং সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইউরোপের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। বস্তুত তাদের জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এ যুদ্ধ। কারণ নিরাপত্তাহীনতার যে সংকট অথবা সবসময় নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকির মধ্যে থাকা-আমার মনে হয় না পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো এ ধরনের পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারবে। ফলে এটি তাদের জন্য একটা বড় ধরনের ক্ষতিই বলতে হবে।

লাভের মধ্যে এটুকু হতে পারে, তারা মনে করছে যে, এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য ফিরে এসেছে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপের এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোকে ক্ষেপিয়ে তুলে তাদের এক ধরনের ফার্স্ট লাইন অফ ডিফেন্স বা কৌশলগতভাবে এ দেশগুলোকে রাশিয়া থেকে আরও অনেক দূরে নিয়ে আসতে পেরেছে এবং তাদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে পেরেছে। এ বিষয়গুলোকে তারা তাদের সফলতা বলে ধরে নিতে পারে। অর্থাৎ রাশিয়ার যে সামরিক ও কূটনৈতিক প্রভাব ছিল এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে, সে প্রভাবটাকে তারা অনেকটা সংকুচিত করতে পেরেছে। তবে এ পরিস্থিতি যে স্থায়ী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

পরিস্থিতি যে কোনো সময় পালটে যেতে পারে। ফলে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের জন্য এ যুদ্ধ একটা বড় ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কৌশলগত দিক থেকে হুমকি তৈরি করেছে। বলতে গেলে ইউরোপ একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং এ যুদ্ধ তাদের একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাদের গতানুগতিক যে লাইফ স্টাইল বা জীবনধারা ছিল, সেটায় চির ধরেছে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপজুড়ে দীর্ঘ সময় যে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল, সেটা আর থাকছে না। আগামীতে একটা শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হয়তো তারা আর দেখবে না।

শুধু ইউরোপজুড়েই নয়, এ যুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যেই বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও পড়তে শুরু করেছে। কারণ বিশ্বে জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে ৪৫ শতাংশ। এ মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে নিু আয়ের মানুষের ওপর। ফলে বিশ্বে খাদ্যনিরাপত্তার ওপর এ যুদ্ধের একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুতরাং বিশ্বকে একটা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে যে কোনো উপায়ে এ যুদ্ধ থামানো উচিত।

ড. দেলোয়ার হোসেন : সদস্য, সরকারি কর্ম কমিশন; অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র: যুগান্তর