



একজন শহিদ ইলমুদ্দিন: আজ থেকে ঠিক ৮৯ বছর পূর্বে ৩১ অক্টোবর, ১৯২৯ উপমহাদেশে একটা ফাঁসির আদেশ বাস্তবায়িত হয়- এক ছুতার মিস্ত্রির ১৯ বছর বয়সী অশিক্ষিত কৃষক ছেলের। কিন্তু তাঁর ফাঁসি ও পূর্বাপর ও পরবর্তী ঘটনা ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত, বিক্ষোভময় ঘটনা। এমনকি এই ঘটনা হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতি, ব্রিটিশ বিরোধিতায় অগ্রগণ্যতা এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রগামীতা এনে দেওয়ায় অন্যতম অনুঘটকের কাজ করে।




১৯২০ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া একটি বই প্রকাশিত হয় ‘রঙ্গিলা রাসুল’ নামে। এখানে ‘রঙ্গিলা’ অর্থ ছিল ‘প্রমোদবালক’ বা ‘প্লে বয়’ অর্থে। বইটার লেখক ছিলেন প্রসাদ প্রতাপ, লিখেছিলেন ছদ্মনাম ‘চামুপতি পণ্ডিত’ নামে। রাজপাল নামে লাহোরের এক হিন্দু পুস্তক ব্যবসায়ী ১৯২৩ সালে বইটা প্রকাশ করেন, লেখকের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়ে।




এ নিয়ে বিক্ষোভ চরমে পৌঁছালে লাহোর সেশন কোর্টে মুসলিম আইনজীবীরা মামলা করেন। তাকে ‘দাঙ্গা’ বাঁধানোর প্রচেষ্টায় দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেয় সেশন কোর্ট। তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিল আদালতে এর শুনানি করেন জাজ দিলীপ সিং। দিলীপ সিং তার সংক্ষিপ্ত রায়ে উল্লেখ করেন, ‘এটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সেকশন ১৫৩ লঙ্ঘন করে না।’ অর্থাৎ তাকে দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগ থেকে অদ্ভুত এক রায়ের মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়।




এই পক্ষপাতপূর্ণ রায় হিসবে অভহিত হয়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়। রাজপাল মুক্তি পান। তবে এই মুক্তির ঘটনা লাহোর থেকে ঢাকা সর্বত্রই মুসলিমদের কাছে ঘৃণ্য বলে পরিগণিত হয়। বিক্ষোভ, মিছিল, সিরাত সম্মেলন চলতে থাকে। লাহোরের মসজিদ ওয়াজির খানের সামনেও বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশ চলছিল। যখন বক্তারা এ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। সেই সময় পথ চলা থামিয়ে বক্তব্য শুনতে থাকেন ইলমুদ্দিন নামে এক অশিক্ষিত, চাষা যুবক।




ইলমুদ্দিন আবেগমথিত হয়ে পড়েন। এক রুপি দিয়ে তিনি বাজার থেকে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ একটা খঞ্জর কিনেন, রাজপালের বইয়ের দোকান খোঁজে সেখানে অপেক্ষা করতে থাকেন। তিনি রাজপালকে চিনতেন না। দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে লকেদের জিগ্যেস করে তিনি রাজপালকে চিনে নেন। সোজা তার বুক বরাবর দুধারি ছুরিটি ঢুকিয়ে দেন। রাজপালের হৃদপিন্ড বিদ্ধ করে এটি। রাজপাল মারা যায়। ইলমুদ্দিন পালানোর চেষ্টা করলেন না।
পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করল। আল্লামা ইকবাল, ব্যারিস্টার মইন উদ্দিন খানসহ অসংখ্য মুসলিম তাঁর পক্ষে মাঠে নামল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ডিফেন্স ল’ইয়ার হিসেবে মামলা হাতে নিলেন। যদিও জিন্নাহ ইতোপূর্বে কখনো মামলায় হারেন নি- তিনি জানতেন এটা সম্ভবত তাঁর প্রথম হার। এই জন্য এই মামলা ‘জিন্নাহ’স অনলি লস্ট কেইস’ নামেও পরিচিত।




সেশন কোর্ট ফাঁসির আদেশ দিলে- উচ্চ আদালতে তা বহাল থাকে। জিন্নাহ তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, “তুমি অল্পবয়সী, আদালতকে বোলো- এ কাজ করার সময় আমি মানসিক স্থিরতাসম্পন্ন ছিলাম না।” ইলমুদ্দিন তা অস্বীকার করেন। ব্রিটিশ সরকার কোনও জানাজা ছাড়াই তাকে দাফন করে। আল্লামা ইকবাল, মইন আব্দুল আজীজ প্রমুখ সর্বজনমান্য মুসলিম নেতারা প্রতিবাদ শুরু করেন। করাচির লোকেরাও তাকে করাচিতে ফেরত চাইতে থাকে। অবস্থা অবনতির দিকে গেলে ব্রিটশ সরকার লাশ উত্তোলনের অনুমতি দেয়।




১৫ দিন পর ১৪ নভেম্বর লাশ উত্তোলন করা হয়- অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল তাঁর দেহ না পচন ধরেছিল, না দুর্গন্ধ ছিল, না তাঁর কাপড়েও কোনও পরিবর্তন ঘটেছিল। দুই দিন পরে লাশ লাহোর পৌঁছায়। পথে লাখ লাখ লোক তাকে শ্রদ্ধা জানায়। লাহোরে দুই লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে জানাজা হয়। ইলমুদ্দিনের বাবা ইকবালকে জানাজা পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জবাব দেন, ‘আমার মত গোনাহগার গাজী ইলমুদ্দিন শহীদের জানাজা পড়ানোর যোগ্য নয়।’




ইলমুদ্দিনের জানাজা পড়ান মসজিদ ওয়াজির আলি খানের ইমাম মাওলানা জাফর আলি খান। ইলমুদ্দিনের শেষ ইচ্ছে জানতে চাইলে তিনি দু’রাকাত নামাজ পড়ার সুযোগ চেয়েছিলেন। ইলমুদ্দিনকে প্রথমে গাজী (বীর) এবং মৃত্যুর পর শহীদ উপাধি দেওয়া হয়। পাকিস্তান জুড়ে অসংখ্য স্থাপনা, পার্ক, রাস্তা, হাসপাতাল, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে তাঁর নামে। তাঁর মাজার জিয়ারত লাহোরজুড়ে এখনো অন্যতম আকর্ষণ।
আল্লামা ইকবালসহ অসংখ্য কবি তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেন। পুস্তকও লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। এই ঘটনার পরের বছরই ইকবাল ‘পাকিস্তান’ রাষ্ট্রতত্ত্ব দেন। এইসব নানাবিধ ঘটনায় পৃথক আবাসভূমির দাবি চূড়ান্ত হতে থাকে। জীবিত ইলমুদ্দিনের চেয়ে শহীদ ইলমুদ্দিন রাজনীতিতে এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী স্বত্ত্বা।




পাকিস্তানের পেনাল কোডের সেকশন ২৯৫ তৈরি হয় তাঁর ঘটনা সামনে রেখে। ১৯৮২ তে সেকশন ২৯৫ বি, ১৯৮৬ তে সেকশন ২৯৫ সি পাকিস্তান পেনাল কোডে অন্তর্ভূক্তিকালে শহীদ ইলমুদ্দিনের কথা ভূমিকায় উঠে আসে। যেসব ধারায় কোরআন অবমাননা, আল্লাহ্র রাসুলকে অবমাননা প্রভৃতি বিষয়ে গুরুদণ্ডের উল্লেখ আছে।
সেদিন যদি এই অপকর্মের জন্য বইটির প্রকাশক রাজপাল শাস্তি পেত, তবে হয়ত এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। অপরাধের শাস্তি না হওয়াই ছিল এ ধরনের ঘটনা সৃষ্টির মূল প্রেক্ষাপট। এ ধরনের দৃষ্টান্ত থাকা স্বত্ত্বেও প্রশাসনের সাবধান না হওয়াটা আধুনিক সময়েও অনেক অঞ্চলের জন্য নতুন করে আলোচনার বিষয় হতে পারে।




#সংগৃহীত পোস্ট। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে একবার করা হয়েছিল। গুরুত্ব বিবেচনায় রিপোস্ট করা হলো। অসম্পাদিত, বি.দ্র. : শহিদ ইলমুদ্দিনকে নিয়ে ‘ফিতনার বজ্রধ্বনি’ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।