ইউক্রেন হামলার নেপথ্য ফাঁস > জানা গেল আসল তথ্য ?

স্বৈরশাসককুলের জন্য পৃথিবীকে নিরাপদ করা এবং আমেরিকার ক্ষমতাকে খর্ব করার চলমান লড়াইয়ের অংশই হলো ইউক্রেন সংকট। রাশিয়া এবং চীন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার পরিকল্পনায় মগ্ন, এই দুইটি দেশ যা যায় গোয়েন্দা রিপোর্ট উল্লেখ করা হল।

ইউক্রেন সংকট যখন তপ্ত হতে হতে ফুটন্ত অবস্থার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে তখন বোঝা যাচ্ছে যে, রাশিয়াকে একঘরে করার এ তৎপরতা হালে পানি পাবে না। রাশিয়ার সুবিশাল প্রতিবেশী দেশ চীনের সমর্থন নিয়ে এ পরিস্থিতি সামলে উঠবে ক্রেমলিন।

মাত্র এক দশক আগেও দেশ দুইটির মধ্যে এমন সম্পর্কের কথা ভাবা যায়নি। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যতোটা অংশীদারি মনোভাব ছিল ঠিক ততটাই প্রবল ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু কিছু সময় পরে দেশ দুইটি অব্যাহত ভাবে আমেরিকার সঙ্গে কলহে জড়িয়ে পড়ে। পুতিনের দাবির প্রতি শি-র সমর্থনের মধ্য দিয়ে মস্কো-বেইজিং’এর বিশ্ব দৃষ্টি এবং স্বার্থ ক্রমেই অভিন্ন হয়ে ওঠার আভাসই দিচ্ছে। চীনা গণমাধ্যম বলছে, “কোনো কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি নির্বিচারে চীন এবং রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের অজুহাতে তারা এমন পদক্ষেপে জড়িয়ে পড়ছে। ”

রুশ এবং চীনা নেতৃবৃন্দের প্রতীতি জন্মেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একযোগে দেশ দুইটির সরকারকে নাজুক করে তুলতে এবং উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে জড়িত রয়েছে। কমিউনিজমের জয় জয়কারের দিনগুলোতে মস্কো এবং বেইজিং দুনিয়ার বিপ্লবী শক্তিগুলোকে দিয়েছে মদদ। হালে প্রতি-বিপ্লবীর অভিধায় ভূষিত হয়েছে মস্কো এবং বেইজিং।

সম্প্রতি কাজাখিস্তানে হাঙ্গামা শুরু হতেই পুতিন অভিযোগ করেন যে আমেরিকা সেখানে “রঙিন বিপ্লব” ঘটানোর পাঁয়তারা করছে। সম্প্রতি সেখানে সরকার পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর চীন ও রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশটিকে নিয়ে এ বক্তব্য দেওয়া হয়। একই অভিযোগের প্রতিধ্বনি শোনা যায় চীনা প্রবীণ মন্ত্রীদের কণ্ঠ হতেও।

আর নয় একমেরু কেন্দ্রিক বিশ্ব :

রুশ এবং চীনারা বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার দুটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রায়ই আপত্তি তোলে। এ দুটি হলো, “এক মেরু কেন্দ্রিকতা” এবং “সার্বজনীনতা।” আরো সহজ করে বললে দাঁড়ায়, দেশ দুটি মনে করে যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থা আমেরিকাকে অনেক বেশি ক্ষমতার যোগান দেয় । এ অবস্থায় তারা এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে বদ্ধপরিকর।

“এক মেরু কেন্দ্রিকতা” বলতে বোঝায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বে কেবল একটিই পরাশক্তি রয়েছে আর সেটি হলো – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রুশ পররাষ্ট্র-নীতি সংক্রান্ত চিন্তাবিদ এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠজন ফিওদর লুকিয়ানভ বিশ্বাস করেন যে বিশ্ব মঞ্চে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যা উপযুক্ত তা করার সক্ষমতা এবং সম্ভাবনা এনে দিয়েছে “এক মেরু কেন্দ্রিকতা।” তিনি আরো বলেন, “এক মেরু কেন্দ্রিকতা”র মধ্য দিয়ে মার্কিন আধিপত্যের নব যুগের সূচনা হয় ১৯৯১ সালের পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের মাধ্যমে। আমেরিকা এ সময় সাদ্দাম হোসেনের ইরাককে কুয়েত থেকে হটিয়ে দেওয়ার জন্য একটি বিশ্ব জোট গঠন করে।”

১৯৯০-র দশকে বসনিয়া এবং কসোভোসহ বিশ্বজুড়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক হস্তক্ষেপের পরপরই সূচনা হয় উপসাগরীয় যুদ্ধের। ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে ন্যাটোর বোমাবর্ষণকে কেন্দ্র করে রাশিয়া দীর্ঘ দিন ধরে বলছে যে ন্যাটো নিছক প্রতিরক্ষা জোট নয়। বেলগ্রেডের চীনা দূতাবাসে ন্যাটো বোমা হামলার ঘটনাও বেইজিং ভুলে যায়নি।

নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলাকে কেন্দ্র করে ন্যাটো অনুচ্ছেদ ৫-এর পারস্পরিক-প্রতিরক্ষা ধারাকে বলবত করা হয়। ফলে আক্রমণ করা হলো আফগানিস্তানে। এর সূত্র ধরে লুকিয়ানভ বলেন, আমেরিকা যে “জোর খাটিয়ে বিশ্বকে পরিবর্তন করার” ইচ্ছা এবং ক্ষমতা রাখে আবারো তাই দেখিয়ে দেয়া হলো।

কিন্তু আফগানিস্তানে আমেরিকার পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে ২০২১ সালের গ্রীষ্মে কাবুল থেকে নজিরহীন হযবরল অবস্থায় মার্কিন সেনা প্রত্যাহার। এতে রাশিয়া প্রত্যাশা করছে যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। লুকিয়ানভ বলেন যে তালেবানের হাতে কাবুলের পতন “বার্লিন প্রাচীরের পতনের চেয়ে মোটেও কম ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীকী হিসেবে বিবেচিত হবে না।” প্রভাবশালী চীনা শিক্ষাবিদরা চিন্তার ক্ষেত্রে একই ধারার অনুগমন করেন। (শি’র সাবেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) বেইজিং-এর সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যালয়ের ডিন ইয়ান জুয়েতং বলেন, “বেইজিং বিশ্বাস করে মহাশক্তির মর্যাদায় চীনের অভ্যুদয় ঘটেছে। চীন এখন বিশ্বব্যবস্থায় একটি নতুন ভূমিকা পালনের অধিকার লাভ করেছে — প্রশ্নাতীত মার্কিন আধিপত্যের সাথে এই নবলব্ধ অধিকার মোটেও খাপ খায় না।”

লুকিয়ানভের মতো ইয়ানও বিশ্বাস করেন যে “মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থা মিলিয়ে যাচ্ছে।” . . তার জায়গায় একটি বহু কেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।” প্রেসিডেন্ট শি নিজেও একে আরো সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি প্রায়ই বলেন, “পূর্বের উদয় ঘটছে এবং পশ্চিম অস্তমিত হচ্ছে।”

একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করা রাশিয়া এবং চীনের জন্য কেবল অপরিশীলিত শক্তি দেখানোর বিষয় নয়। এটা আদর্শের লড়াইও। পশ্চিমা উদারনৈতিক ঐতিহ্য সর্বজনীন মানবাধিকারের বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু রুশ এবং চীনা চিন্তাবিদরা বলেন যে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং “সভ্যতা-কে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।

পুতিনের এককালের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ভ্লাদিস্লাভ সুরকভ “পশ্চিমা সভ্যতার অংশ হওয়ার জন্য বারবার ব্যর্থ চেষ্টার” জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন এমন চেষ্টা করার বদলে বরং রাশিয়ার মেনে নেওয়া উচিত যে সে “পূর্ব এবং পশ্চিম উভয়কেই ধারণ করছে” আর দেশটির রয়েছে “(পূর্ব এবং পশ্চিমের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা) শংকর মানসিকতা।”

বেইজিংয়ের সরকারপন্থী চিন্তাবিদরাও একই সুরে সুর মেলান। তাঁরা বলেন, কনফুসিয়ানিজম এবং কমিউনিজমের সংমিশ্রণের মানে দাঁড়াচ্ছে চীন সব সময়ই এমন এক দেশ সেখানে ব্যক্তি অধিকারের পরিবর্তে সামষ্টিক অধিকারের উপর জোর দেয়া হয়। তাঁরা আরো দাবি করেন যে, যৌথ পদক্ষেপ এবং গোষ্ঠী অধিকারের উপর চীনা গুরুত্বারোপের শ্রেষ্ঠত্বকেই তুলে ধরেছে কোভিড -১৯ নিয়ন্ত্রণে চীনের সফলতা।

বেইজিং এবং মস্কো যুক্তি দেখায় যে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রয়োজন মনে করলে অন্য দেশের ওপর গণতন্ত্র ও মানবাধিকার চাপিয়ে দিতে পারে আমেরিকা। এ জন্য দরকার হলে সামরিক হস্তক্ষেপেও দ্বিধা করেনা আমেরিকা। রাশিয়া এবং চীন যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার দাবি করছে সেখানে এমন বল প্রয়োগের বদলে স্বতন্ত্র প্রভাব বলয়গুলো সুচিহ্নিত থাকবে। নিজ নিজ প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর রাশিয়া এবং চীনের আধিপত্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে। পাশাপাশি পুতিন বা শি সরকারকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে এমন রঙিন বিপ্লব বা গণতন্ত্রের প্রতি নিজ সমর্থনও ওয়াশিংটন ত্যাগ করবে।