জিয়া হত্যার পর জেনারেল মনজুর বললেন- ‘এরশাদ চোর, এদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে’

সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকা- নিয়ে এর আগে নানা খবর ছাপা হয়েছে। এবার জিয়া হত্যা নিয়ে চাঞ্চল্যকর নতুন তথ্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বইয়ে তুলে ধরেছেন লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার জবানি নিয়ে তার লেখা এই বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য জিয়া হত্যাকা-ের ঘটনার দ্বিতীয় পর্ব তুলে ধরা হলো-

সরি স্যার, ভয়ে কইছি।

শোনেন, আমি কোনো দলেটলে নাই। আমি বাসায় ঘুমায়া ছিলাম। এখন আমারে দায়িত্ব দিছে, আপনারা যারা এখানে আছেন, আপনাদের কোনো সেফটি অ্যারেঞ্জমেন্ট নাই। আপনাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়া যাইতে আসছি।

আপনারা রেডি হন।

ওরা রেডি হচ্ছে। রেজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন।

দেখলেন, বারান্দায় একটা ডেডবডি। বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা। একজন সেপাই দাঁড়িয়ে।

কার বডি?

স্যার, প্রেসিডেন্টের।

মুখের ওপর থেকে কাপড়টা সরাও।

কাপড়টা সরাতেই মুখটা দেখলেন রেজা। কাত হয়ে শুয়ে আছেন। গুলি যেভাবে লেগেছে, এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে। এপার-ওপার দেখা যায়। গায়ে নতুন একটা পাঞ্জাবি। শুধু মুখটা দেখেই রেজা কাপড়টা টেনে ঢেকে দিলেন মৃতদেহ।

পাশেই আরেকটা ডেডবডি, লে. কর্নেল আহসানের। একটু দূরে আরেকটা ডেডবডি, কম্বলে ঢাকা। কিন্তু পা বেরিয়ে আছে। কম্বলটা একটু সরিয়ে রেজা দেখলেন, এটা তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন হাফিজের মরদেহ। যে বন্ধুকে নিয়ে বিকেলে গাড়িতে করে ঘোরার কথা, সে এখানে নিথর শুয়ে আছে। রেজার সঙ্গে ছিল একজন হাবিলদার। আগে সে হাফিজের সঙ্গে চাকরি করেছে। সে চিৎকার করে উঠল। স্যার, আমাদের মাখন স্যাররে মাইরা ফেলছে!

হাফিজের ডাকনাম মাখন।

সৈনিকদের মধ্যে যারা খুব ঘনিষ্ঠ, রেজা তাদের তুই সম্বোধন করতেন। বললেন, কথা বলিস না, চুপ করে থাক।

জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল আহসান আর ক্যাপ্টেন আশরাফুল হাফিজ খানের মরদেহ নিচে নামানো হলো। তাঁদের একটা পিকআপে উঠিয়ে মেজর শওকত চলে গেলেন। গার্ড রেজিমেন্টের লোকদের নিয়ে রেজা ফিরে এলেন ক্যান্টনমেন্টে। তাঁদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে রেজা গেলেন কর্নেল মতির কাছে।

স্যার, আমি তো ওদের নিয়া আসছি? ওদেরকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে মেজর মুজিবের কাছে নিয়া যাও।

তাকে বলো, ওদের সেগ্রিগেট করে রাখতে, যাতে অন্যরা ওদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে।

গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যদের নিয়ে রেজা গেলেন মেজর মুজিবের কাছে। সেখানে তাদের রেখে অফিসে ফিরে এসে কর্নেল মতিকে না। জিওসি জেনারেল মনজুরের অফিসের সামনের বারান্দায় কর্নেল মতি একটু আগেও হম্বিতম্বি করছিলেন। অফিসের পেছনে আরেকটা বারান্দা আছে। বারান্দার অন্য পাশে রেজার অফিস। রেজা দেখলেন, জেনারেল মনজুর পেছনের বারান্দায় অস্থিরভাবে পাঁয়চারি করছেন। তাকে দেখেই হাঁক দিলেন,

রেজা, কাম হিয়ার।

স্যার।

তুমি এখন কোত্থেকে আসছ?

স্যার, সার্কিট হাউজ থেকে আসলাম।

কী দেখলে? এই এই দেখলাম। হাফিজও মারা গেছে, স্যার। কী বললে? হোয়াট হ্যাপেনড টু হাফিজ?

স্যার, হি ইজ অলসো ডেড। হোয়াট? ওহ, হোয়াট হ্যাভ দে ডান? তুমি কি কাল সার্কিট হাউজে গিয়েছিলে?

না স্যার, আমি বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম। তোমার মাথা ঠান্ডা আছে?

স্যার, ঠান্ডা আছে। সারা রাত ঘুমিয়েছি। ওদের তো মাথা গরম। তোমার মাথা তো ঠান্ডা আছে। ইউ গিভ মি ফুল সিকিউরিটি। এখন থেকে তুমি আমার চিফ সিকিউরিটি অফিসার।

জেনারেল মনজুর রেজার দুই কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিলেন। রেজা ঠকাস করে স্যালুট দিলেন। তিনি জড়িয়ে গেলেন জেনারেলের সঙ্গে। রেজা কয়েকজন সৈনিককে বাছাই করলেন, যারা তাঁর অনুগত, বিশ্বস্ত। তাদের অস্ত্র দেওয়া হলো। রেজা তাদের বললেন, যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে, কেউ জেনারেল মনজুরকে স্পর্শ করতে পারবে না। জেনারেল মনজুরের ডিউটি শুরু হলো মেজর রেজার।

রেজাকে নিয়ে মনজুর ২৮ বেঙ্গলে গেলেন। সেখানে আছেন মেজর জামিল। ব্রিগেড কমান্ডার মহসিনও এলেন। মনজুর একটা বক্তৃতা দিলেন সেখানে- দেশ দুর্নীতিতে ভরে গেছে। সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসাররাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। সেনাপ্রধান এরশাদ হলো এক নম্বর চোর। এই চোরদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন। এরশাদ এখন ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে। সে দুর্নীতিবাজ। তার হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না।

টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দ। রিসিভার তুলতেই অন্য প্রান্তে ঢাকা সেনাসদর থেকে সিজিএস মে. জে. নূরউদ্দিনের কণ্ঠ। জেনারেল মনজুরকে চাচ্ছেন।

হ্যাঁ, নূরউদ্দিন, কী ব্যাপার? স্যার, প্লিজ টক টু জেনারেল এরশাদ।

হোয়াই ব্লাডি এরশাদ? হি ইজ আ থিফ! হি ইজ আ করাপ্ট পারসন! ওর সঙ্গে আমি কথা বলব না। মনজুর ঠকাস করে রিসিভার রেখে দিলেন। আবার ফোন। বললাম তো, ওর সঙ্গে কোনো কথা বলব না।

স্যার, ফর গডস সেক, কুল ডাউন।

মনজুর ডান হাত কাত করে ফোন ধরেছিলেন। রিসিভারটা এমনভাবে কানের কাছে ধরেছিলেন যে পাশে দাঁড়িয়ে রেজা সব শুনতে পাচ্ছেন। তিনি নূরউদ্দিনের কণ্ঠস্বর চেনেন। তাঁর সঙ্গে তিন বছর চাকরি করেছেন। নূরউদ্দিনের গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি সব রেজার মুখস্থ।

স্যার, প্লিজ কুল ডাউন, টক টু জেনারেল এরশাদ। নো ওয়ে। হি ইজ করাপ্ট, থিফ, ওমেনাইজার। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারি না।

ফোনটা আবারও রেখে দিলেন মনজুর।

ততক্ষণে ঢাকার পরিস্থিতি বদলে গেছে। কেউ আর মনজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। রেডিও-টেলিভিশন প্রচার শুরু হয়ে গেছেÑ মেজর জেনারেল মনজুরের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়েছে। কেউ যেন তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা না করে।

রেজাকে নিয়ে মনজুর গেলেন আর্টিলারি সেন্টারে। তুমুল বৃষ্টি। সবাই অস্ত্র হাতে বসে আছে। ওরা চাইলে মনজুরকে তখনই আটকাতে বা মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু রেজা আর তার লোকেরা নিরাপত্তাবলয় এমনভাবে তৈরি করেছে যে সেটা খুব কঠিন হবে।

মনজুর ইবিআরসির কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার আজিজকে ফোন করে বললেন, আমি একা একা ঘুরছি। এটা ভালো লাগছে না। আপনার মতো একটা ব্রিলিয়ান্ট অফিসার আমার সঙ্গে না থাকলে হয়? আপনি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন।

ইবিআরসিতে আরেকজন আজিজ আছেন, কর্নেল আজিজ। তিনি এসে মনজুরকে বলেছিলেন, ব্রিগেডিয়ার আজিজ গোপনে সবাইকে মনজুরের বিরুদ্ধে সংগঠিত করছেন। একটা মেরুকরণ হচ্ছে। একদিকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা, অন্যদিকে রিপ্যাট্রিয়েট অফিসাররা। এটা শুনেই মনজুর ডেকে পাঠান ব্রিগেডিয়ার আজিজকে। উদ্দেশ্য, তাঁকে চোখে চোখে রাখা।

ব্রিগেডিয়ার আজিজ এলেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মনজুর গেলেন জেলা প্রশাসকের অফিসে। সেখানে সাংবাদিকেরা ভিড় করে ছিলেন। সবাই ছবি তুলতে চান। সাংবাদিকেরা যখনই ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, ব্রিগেডিয়ার আজিজ তখনই চলে যান দরজার কাছে। রেজাকে বললেন, সিকিউরিটি সব ঠিক আছে? রেজা ব্রিগেডিয়ার আজিজের চালাকি বুঝতে পারলেন। তিনি মনজুরের সঙ্গে ছবি তুলতে চান না।

ছবি তোলার পালা শেষ। সবাই ফিরে এলেন ক্যান্টনমেন্টে, ডিভ হেডকোয়ার্টারে। ততক্ষণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। শুরু হয়ে গেছে দলবদল। চট্টগ্রাম আর ফেনীর মাঝামাঝি শুভপুর ব্রিজ। ব্রিজের এপার মনজুরের অনুগত বাহিনী। ওপারে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েকটা ইউনিট এসে জড়ো হয়েছে। তাদের লক্ষ্য, মনজুরের লোকেরা যেন নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে আসতে না পারে।

মেজর দোস্ত মোহাম্মদ তাঁর ইউনিট নিয়ে আগেই চলে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুভপুরে মনজুরের প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে পড়ে। রেডিওতে বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণের জন্য বারবার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছিল। অনেকেই সাড়া দিয়ে ওপারে চলে যান। মেজর গিয়াস আর মেজর মোমেন তখনো সেখানে। মেজর কাইয়ুম তাঁদের বললেন, তোমরা হেডকোয়ার্টারে ফিরে। যাও, আমি এদিকটা দেখছি।

গিয়াস আর মোমেন একটা গাড়ি নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর তাঁদের মনে হলো, ওয়্যারলেসে যোগাযোগ না করেই কেন যাব? গাড়ি ঘুরিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসে দেখেন মেজর কাইয়ুম ততক্ষণে চলে গেছেন ওপারে।

চট্টগ্রামে ব্রিগেড তিনটি। একটির কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ। তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেন মনজুর। মনজুর তাঁকে বললেন, তিনি ঢাকার সঙ্গে কথা বলতে চান। হান্নান শাহ ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সেনাসদরের সাফ জবাব, মনজুরকে আগে সারেন্ডার করতে হবে। মনজুর বললেন, তাঁর কিছু শর্ত আছে। ৩০ মিনিট কথা চালাচালি হলো। কোনো মীমাংসা হলো না।

ডিভ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে একটা হেলিপ্যাড আছে। একটা হেলিকপ্টার সেখানে অপেক্ষমাণ। মনজুর পার্বত্য চট্টগ্রামে গেলে এটা ব্যবহার করেন। তিনি হেলিপ্যাড থেকে হেলিকপ্টারটি সরিয়ে ফেলতে বললেন। তাঁর মনে হলো, যদি এখানে হেলিকপ্টার থাকে, তাহলে সৈন্যরা মনে করবে যে মনজুর যেকোনো সময়ে হেলিকপ্টারে চড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। তখন তাদের আর মনোবল থাকবে না। তিনি হেলিকপ্টারটিকে চট্টগ্রাম এয়ার বেইজে পাঠিয়ে দিতে বললেন। হেলিকপ্টার উড়ে গেল এয়ার বেইজের উদ্দেশে।

ঢাকা থেকে রেডিওতে ঘন ঘন ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এই সময়সীমার মধ্যে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না। একপর্যায়ে স্রোতের মতো সবাই আত্মসমর্পণ শুরু করে। এমনকি যারা সার্কিট হাউজের অপারেশনে গিয়েছিল, তারাও অনেকে চলে গেল। মেজর রেজা তখনো মনজুরের ডিউটি করে যাচ্ছেন।

এক ফাঁকে রেজা এমপি চেকপোস্টের পেছনে তাঁর বাসায় গেলেন।

তাঁর স্ত্রীর চোখেমুখে উদ্বেগ। চলো আমরা দুজন একটা গাড়ি নিয়ে চলে যাই। তুমি তো এর মধ্যে ছিলে না। তোমার তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমি কিছুতেই পালাব না। আমি জেনারেল মনজুরের দায়িত্ব নিয়েছি। তাঁকে ছেড়ে আমি যাব না।

উৎসঃ মানবজমিন