সর্বত্র শিশুশ্রম নিষিদ্ধ হলেও ঘর থেকে বের হলে দেখতে পাবেন শিশুশ্রমের করুণ চিত্র। হোটেল, মোটেল, লঞ্চ, বাস, হিউম্যান হলার, ইটভাটা, পাথর ভাঙা, মোটর গ্যারেজ, অ্যালুমিনিয়াম কারখানা, কলকারখানা, বাসাবাড়ি, মিষ্টি ও বিস্কুট ফ্যাক্টরি, তামাকশিল্প, চামড়াশিল্প, চাশিল্প ইত্যাদিতে শিশুশ্রমের ছড়াছড়ি। দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারের সন্তানেরা দু’বেলা দু’মুঠো ভাত মুখে দেয়ার জন্য নিরুপায় হয়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে।
শিশুর বয়সসীমা এবং তাদের শ্রমের সংজ্ঞা নিয়ে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ হয়েছে। ১৯৭৪ সালে চিলড্রেন অ্যাক্টে শিশুর বয়স ১৬ বছর করা হয়। ১৯৮৯ সালে জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার সনদে মতামত রাখা হয়েছিল ১৮ বছর হবে শিশুর সর্বোচ্চ সময়কাল। ১৯৯৪ সালে প্রণীত জাতীয় শিশু নীতিতে শিশুদের বয়স ১৪ বছর করা হয়েছিল। ২০০৩ সালের ১ জুন শিশুর বয়সসীমা ১৬ বছর নির্ধারণ করা হয়। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন ২(৬৩) ধারায় ‘শিশু’ অর্থ ১৪ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন কোনো ব্যক্তি। ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতি ২-১ ধারায় শিশু বলতে ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো ব্যক্তিকে বুঝায়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুশ্রম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যখন কোনো শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর দৈহিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য হবে।
ইউনিসেফ শিশুশ্রম সংজ্ঞায়িত করেছে যে ধরনের কাজ শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে ব্যাহত করে তা-ই শিশুশ্রম। বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ২০১১ সালে সরকারি এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৭৯ লাখ। জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৩-এ উল্লিখিত হয়েছে প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শ্রমে নিয়োজিত।
২০১৩ সালের শ্রম জরিপে দেখা যায়, পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সের কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ। বিবিএস কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, শিশুশ্রমের সাথে জড়িত ১৭ লাখ শিশু। এর মধ্যে ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা, ১৮ অনুচ্ছেদে পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ২৮ অনুচ্ছেদে কল্যাণ ও উন্নয়ন বিশেষ আইন প্রণয়ন করা এবং ৩৪ অনুচ্ছেদে জোরপূর্বক শিশুশ্রমে নিয়োগ নিষিদ্ধ করার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। শিশুশ্রম বন্ধের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে অসংখ্য নীতিমালা। দেশ স্বাধীনের আগে শিশুদের বয়স, শ্রম, অধিকার ও কল্যাণ ইত্যাদির ব্যাপারে আইনি কাঠামো ছিল ‘দ্য চিলড্রেন অ্যাক্ট ১৯২৯, শিশুশ্রম আইন ১৯৩৩, শিশু নিয়োগ অ্যাক্ট ১৯৩৮, ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্ট ১৯৬৫ এবং দেশ স্বাধীনের পরে ১৯৭৪ সালে চিলড্রেন অ্যাক্ট, ১৯৮৯ সালে জাতিসঙ্ঘের শিশু অধিকার সনদ, ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশু নীতি, ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা, ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতিমালা, ২০১২-২০১৬ শিশুশ্রম নিরসন জাতীয় পরিকল্পনা, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ শিশু আইন এবং বাংলাদেশ শ্রম আইনের সংশোধনী, ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি, বিভাগীয় চাইল্ড লেবার ওয়েলফেয়ার কমিটি, জেলা শিশু অধিকার ফোরাম, উপজেলা চাইল্ড লেবার মনিটরিং কমিটিসহ অসংখ্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল।
২০১০ সালে গৃহীত জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি কার্যকরের জন্য ২০১২ সালে পাঁচ বছরমেয়াদি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১২-২০১৬ গ্রহণ করে সরকার। এতে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, ২০১৬ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নির্মূল করা হবে; কিন্তু আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাই আবার ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের নতুন পরিকল্পনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সরকারের দাবিÑ সরকার, আইএলও, ইউনিসেফ, ওয়ার্ল্ড ভিশন, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বিভিন্ন এনজিওর গৃহীত উদ্যোগের কারণে শিশুশ্রম কমে এসেছে। শিশুশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা বলেছেন, শিশুর কাজের ধরন এবং ক্ষেত্র পাল্টাচ্ছে, বাস্তবে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতিতে বলা হয়েছেÑ পাঁচ থেকে ১৮ বছরের কোনো শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো যাবে না।
পাঁচ থেকে ১৪ বছরের শিশুকে কর্মে নিয়োগ দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। শিশু আইন ২০১৩-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার দায়িত্বে থাকা শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন বা অবহেলা করেন তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শিশুশ্রম নিরসনে করণীয় : ০১. শিশুশ্রমের মূলে দারিদ্র্য, শিশুশ্রম রুখতে হলে আগে দারিদ্র্য রুখতে হবে, ০২. শিশুশ্রম বন্ধে জরুরি মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, অন্যজনের শিশুকে নিজের সন্তান মনে করা, ০৩. শিশুশ্রম দূরীকরণ তথা শিশুদের জীবনের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য চাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, ০৪. শিশুশ্রম বন্ধে গ্রাম ও শহরভিত্তিক পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করা।
অভাবের কারণে যেসব শিশু শ্রমে নিয়োজিত হচ্ছে তাদের তালিকা তৈরি করে সরকারের উচিত শিশু ভাতা প্রদান করা, ০৫. শিশুশ্রম নিরসনে যেসব আইন আছে তা বাস্তবায়ন এবং স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। সবার সমন্বিত উদ্যোগে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব, ০৬. শিশুশ্রম নিরসনের জন্য কোথায় কোথায় শিশুশ্রম হচ্ছে তা খুঁজে বের করা দরকার এবং গণমাধ্যমে এ বিষয়ে বেশি বেশি প্রচার করা, ০৭. অনেক মালিক আছেন, বেশি বেতন দিতে হবে এ জন্য বড়দের কাজে রাখেন না। শিশুদের দিয়ে কাজ করান, এসব মালিকের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা, ০৮. জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মকৌশলে শিশুশ্রমকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দিতে হবে, ০৯.
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের জনবল বৃদ্ধি করতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, নির্যাতনের শিকার শিশুরা সমাজের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। একটি শিশুকে কাজে ঠেলে দেয়া মানে সম্ভাবনাময় স্বপ্নকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া। শিশুদের মনোজগৎ ও বহির্জগতে জাতিসত্তা বিকাশের জন্য সুযোগ করে দেয়া আমাদের কর্তব্য। নিজের বাসাবাড়িতে শিশুকে দিয়ে কাজ করানো সবার আগে বন্ধ করা নৈতিক দায়িত্ব। শিশুরা শারীরিক, মানসিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষায়, চেতনায় ও মননে যত সমৃদ্ধ হবে, জাতির ভিত্তি তত মজবুত হবে। আমাদের দেশে অনেক শিশু তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত ও নিগ্রহের শিকার। রাষ্ট্র, সমাজ ও আমাদের সবার দায়িত্ব শিশুদের অধিকার রক্ষা করা। সর্বাবস্থায় মানবতা লঙ্ঘিত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে পরে সম্ভব উন্নত জাতির স্বপ্ন দেখা।
জসিম উদ্দিন খন্দকার
লেখক : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, সিলেট
Naya Diganta