গাজীপুরে বিএনপির হাসানের পাশে আ.লীগের এক পক্ষ

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমকে হারাতে আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে কাজ করছেন বলে তথ্য পেয়েছে আওয়ামী লীগ।গত রবিবার ক্ষমতাসীন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গাজীপুরের নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে এ বিষয়ে সতর্কও করেছেন। বলেছেন, জাহাঙ্গীর হারলে সেখানে কেউ সংসদ সদস্য হতে পারবেন না।

ওই দিন ধানমন্ডির একটি কমিউনিটি সেন্টারে গাজীপুরের নেতাদের সঙ্গে কাদেরের এই আলোচনা হয়। ওই বৈঠক সম্পর্কে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকর্মীদের বিস্তারিত জানানো হয়নি। তবে বৈঠকের একটি ভিডিও ক্লিপ ইউটিউবে পাওয়া গেছে।

ওই বৈঠকে গাজীপুরের আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরোধ মেটাতে কাদের ছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক জাহাঙ্গীর কবির নানক, গাজীপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, টঙ্গীর আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, কাপাসিয়ার সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজ।

এছাড়াও গাজীপুর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েক শ নেতাকর্মী এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

ইউটিউবে আপ হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ওবায়দুল কাদের দলের নেতাদের বলছেন, ‘অনেকেরই তথ্য আছে আমার কাছে। দেখতেছি যে, কে কী করেন?’‘হাসান সরকারকে বলে যে, আপনাকেই ভোট দেব, এমনি আছি জাহাঙ্গীরের সাথে। এরকম যারা করেন তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়ে চলে যান, আমাদের দরকার নেই। এরকম বেইমানের আমাদের দরকার নেই। দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।’

২০১৩ সালে নির্দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আজমত উল্লাহ খানকে সমর্থন দেয়ায় হতাশ ছিলেন এবার দলীয় প্রতীকের প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। আবার এবার জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেয়ায় আজমতের হতাশা স্পষ্ট। আর আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত এলাকায় দেড় লাখ ভোটে হারের পেছনে দলীয় কোন্দল, এক পক্ষের বিরোধিতা এমনকি বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন দেয়াও ছিল অন্যতম কারণ।

এর মধ্যে এবার গত ২৪ এপ্রিল আজমতকে জাহাঙ্গীরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট করা হয়। তারপরও তিনি গোপনে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কাজ করছেন বলে তথ্য এসেছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রে।গত ২৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাতেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। আর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, বিষয়টি জানতে পেরে তিনি আজমতকে ফোন করেছেন। বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি তুলবেন তিনি।

এর পরদিন থেকে জাহাঙ্গীরের পক্ষে ভোটের প্রচারে নামেন আজমত। তবে তার প্রভাব বলয়ের বহু নেতা-কর্মী এখনও নীরব বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।এ ছাড়াও সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হকসহ বিভিন্ন প্রভাব বলয়ের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল ওই নির্বাচনে।

সেসব দ্বন্দ্ব এবারও মিটেছে, সেটা হলফ করে এবারও কেউ বলতে পারছে না। আর এই দ্বন্দ্ব না মেটালে ভোটের ফলাফল ক্ষমতাসীন দলের জন্য সুখকর হবে না বলেই ধারণা করছেন সমর্থকরা।

এই পরিস্থিতিতে রবিবারের ওই বৈঠকে গাজীপুরের দুই সংসদ সদস্য মোজাম্মেল ও রাসেলকে আওয়ামী লীগের বিরোধ মেটানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। আর ওই দুই নেতা সেদিন রাত ১১টা থেকে দুইটা অবধি গাজীপুরের নেতাদেরকে নিয়ে বৈঠক করেন।

‘জাহাঙ্গীর হারলে এমপি হওয়া হবে না’

গাজীপুরে জাহাঙ্গীর হারলে আওয়ামী লীগের কারও সংসদ সদস্য বা এমপি হওয়া হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের।

বলেন, ‘এখানে দল বড়, জাহাঙ্গীরের বিষয় নয়। জাহাঙ্গীরকে আপনারা অনেকে পছন্দ করতেও পারেন, আবার নাও করতে পারেন। কিন্তু এই ইলেকশনে না জিতলে জাতীয় নির্বাচনে আমি জিতব এই আশা করবেন না। এটা একদম পরিস্কার। এটা একেবারেই সেমিফাইনাল, এটাতে না জিতলে ফাইনালে যেতে পারবেন না।’

‘যারা এমপি হতে চান, এই নির্বাচনে হারলে এমপি আর হতে পারবেন না। আমি লিখে দেব হতে পারবেন না। যে যা ভবিষ্যতে হতে চান, হতে পারবেন না যদি এটা না হয়। কেউ আর ভোট দেবে না। এগুলা একটু মাথায় রাখবেন।’

আগামী ১৫ মে খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে যে ভোট হবে, তাতে দেশে আওয়ামী লীগ না কি বিএনপি বেশি জনপ্রিয় সেটার একটা নমুনা বুঝা যাবে। এই দুই নগরের মধ্যে আবার গাজীপুর ভোট বেশি, ১১ লাখ ৬৪ হাজার ৪২৫ জন। অন্যদিকে খুলনায় ভোটার চার লাখ ৯৩ হাজার ৪৫৪ জন।এ কারণে গাজীপুরকে সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, সে বিষয়টি জানিয়ে কাদের বলেন, ‘খুলনাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো গাজীপুর। ভোটারও বেশী এখানে।’

‘আপনাদের সকলের কাছে আমি অনুরোধ করছি, মনের মধ্যে কিছু রাখবেন না। মুখে একটা মনে আরেকটা এটা যেন না হয়।’

‘বেইমানদেরকে ছাড় নয়’

ভোটে যারা বেইমানি করবে তাদেরকে আওয়ামী লীগ কোনো ছাড় দেবে না বলেও জানিয়ে দেন কাদের। বলেন, ‘গতবার পরাজয়কে আমরা মেনে নিয়েছি বহু কষ্টে। এবার পারব না। এবার যারা এখানে বিরোধিতা করবে, বেইমানি করবে, একদম আজীবনের জন্য বহিস্কার।’

‘এবার আর কাঁদলে লাভ হবে না, একদম বহিষ্কার করব প্রমাণ পেলে। প্রমাণ পেতে হবে, উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে তো এটা (বহিস্কার) করা যাবে না। যেই হোক, হি উইল বি এক্সপেইল।’

‘আমি আপনাদেরকে শাসিয়ে, গালিগালাজ করে কাজ করাতে পারব না। এটা প্রত্যেকেরই মনের ব্যাপার। আজকে আপনি কথা দিয়ে গেলেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে কেটে দিলেন। এটা তো আমি দেখব না। এটা আমি দেখব না, এটাকে গোপনও রাখা যাবে না।’

কাদের বিশেষভাবে সতর্ক করলেন আজমতকে

গত ২৬ এপ্রিল ফোনে এক দফা সতর্ক করার পর এই বৈঠকেও মনোনয়নবঞ্চিত আজমত উল্লাহ খানকে সবার সামনেই সতর্ক করেন কাদের।

গত নির্বাচনে দলের একাংশের বিরোধিতায় আজমতের পরাজয়ের বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে কাদের বলেন, ‘আজমত উল্লাহ, তুমি গতবার তো ইলেকশন করছ। তারা (দলের বিদ্রোহীরা) কী করেছে ওইটা তুমি জান না? তারাও জানে, তারা (এবার যারা বিদ্রোহী) কী করবে। গতবার আমরা ক্ষমা করছি, এবার করব না পরিস্কার কথা। এটা আমি নেত্রীর পক্ষ থেকে সবাইকে জানাচ্ছি।’

এই নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘এই বিজয়টা আমাদের দরকার। তা নাহলে আমরা জাতীয় নির্বাচনে পাস করতে পারব না। আওয়ামী লীগের কর্মীরা শুয়ে পরবে সারাদেশে। এ হতাশার দরিয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।’‘বিজয় ছিনিয়ে আনার মতো, বিজয়ী হওয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য দুটোই আপনাদের আছে। সমর্থনও আছে।’

‘আওয়ামী লীগের নেতারা কারো কাছে বিক্রি হওয়ার মতো না। এটা অতীতে প্রমাণ আছে। ব্যক্তিগতভাবে কারো প্রতি কারো ক্ষোভ থাকতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দলের দিকে তাকিয়ে, বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে, নেত্রীর দিকে তাকিয়ে, আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে দয়াকরে সবাই একজোট হয়ে কাজ করুন।’‘অনেকেই প্রার্থী হতে চান বিভিন্ন নির্বাচনে। আমি আপনাদেরকে এইটুকু বলব, হতাশ হবেন না। রাজনীতিতে লেগে থাকলে আপনি পাবেন।’