রাজধানীতে ঘরের ভেতর মা-দুই মেয়ের গলাকাটা লাশ

বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো বই-খাতা। কাঁচা হাতে নাম লেখা- হাসিবা তাসনীম হিমি। দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মায়ের সঙ্গে পড়তে বসতো শিশুটি। তবে সোমবারের সন্ধ্যাটা ছিল অন্যরকম। বাড়ি ভর্তি মানুষ। হিমি, তার চার বছরের ছোট বোন আদিলা তাসনীম হানি আর মা জেসমিন আক্তারের (৩৫) গলাকাটা লাশ ব্যাগে করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

রাজধানীর মিরপুরের বাঙলা কলেজ সংলগ্ন পাইকপাড়ার ‘সি টাইপ সরকারি কোয়ার্টার’-এর ১৩৪ নম্বর ভবনের চার তলার ফ্ল্যাট থেকে জেসমিন আক্তার ও তাঁর দুই মেয়ের গলাকাটা লাশ সোমবার সন্ধ্যায় উদ্ধার করে পুলিশ।জেসমিন আক্তার ছিলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ক্যাশিয়ার। তাঁর স্বামী হাসিবুল ইসলাম সংসদ সচিবালয়ের সহকারী লেজিসলেটিভ ড্রাফটসম্যান। পাইকপাড়া সি টাইপ কলোনিতে পরিবারটি প্রায় ১০ বছর ধরে বসবাস করছিল।

লাশ উদ্ধারের পর ওই কে বা কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা নিয়ে ওই কলোনিতে চলছে জল্পনাকল্পনা। ফুটফুটে দুটি শিশু আর তাদের মাকে কেউ এতটা নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে তা ভেবে শিউরে উঠছেন প্রতিবেশীরা। জেসমিন আক্তারের হাতের কবজি ও গলা কাটা অবস্থায় ছিল।

এদিকে পরিবারের লোকজন আর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে লাশ উদ্ধারের তিন ঘণ্টা পরই পুলিশ জানিয়েছে, দুই সন্তানকে হত্যার পর জেসমিন আক্তার আত্মহত্যা করেছেন বলে তারা ধারণা করছে। স্বজনেরা পুলিশকে বলেছেন, জেসমিন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। এর আগেও তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিকিৎসা চলছিল। তবে নিজের শরীরের একাধিক জায়গায় ছুরিকাঘাত করে আত্মহত্যা করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

হিমি ও তার ছোট বোন আদিলা তাসনীম হানি । ছবি: সংগৃহীত

হিমি ও তার ছোট বোন আদিলা তাসনীম হানি । ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবেশী যারা ওই দুই শিশু আর তাদের মায়ের লাশ দেখেছেন তাঁদের দু’জন কেঁদে ফেলেন। প্রথম আলোকে বলেন, এর চেয়ে নৃশংস ঘটনা তাঁরা জীবনে দেখেননি। দুটি শিশুরই গলা কাটা ও পেট চেরা ছিল। নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে রয়েছে। ঘরের চারদিকে রক্তের ছোপ। আর জেসমিন আক্তারের হাতের কবজি ও গলা কাটা। তাঁরও পেট চেরা। তাঁরা কখনোই ধারণা করতে পারেন না যে, এ ঘটনা আত্মহত্যা হতে পারে। এমনকি ওই ফ্ল্যাটের একতলা নিচের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, তাঁরা কোনো ধরনের চিৎকার বা দাপাদাপির শব্দ শোনেননি। প্রতিবেশী তো দূরের কথা। জেসমিনদের ফ্ল্যাটেই তখন তাঁর এক খালাতো বোন রেহানা বেগম, স্বামীর ভাগনে রওশন জামিল এবং তাঁর (জামিল) স্ত্রী রোমানা পারভীন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কেউও কোনো ধরনের চিৎকার বা দাপাদাপির কোনো শব্দ পাননি।

ওই স্বজনেরা বলেন, সোমবার বেলা দুইটার দিকে অফিস থেকে ফিরে দুই মেয়েকে খাটে বসিয়ে ভাত খাওয়ান জেসমিন। এরপর নিজে না খেয়েই তাদের নিয়ে ঘরের দরজা আটকে শুয়ে পড়েন। ভেতরে টিভিও চলছিল। জেসমিনের মাইগ্রেনের ব্যথা আছে বলে তিনি শুয়ে থাকলে পরিবারের কেউ তাঁকে জাগান না। জেসমিনের ভাই শাহীনুল ইসলাম বাসার বাইরে ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে জেসমিনের স্বামী হাসিবুল বাসায় ফেরেন। স্ত্রী ও দুই মেয়ে ঘুমাচ্ছে ভেবে তিনি তাঁদের না জাগিয়েই নামাজ পড়তে চলে যান। সন্ধ্যা সাতটার দিকে জেসমিনের ভাই শাহীনুল বাসায় ফিরে দরজায় শব্দ করেন। বোন ও ভাগনিদের সাড়া না পেয়ে উঁকি মেরে কাচের ফাঁক দিয়ে রক্ত দেখতে পান। এরপর তিনি দরজা ভেঙে তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার শুরু করেন। প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে জড়ো হন। এর মধ্যেই হাসিবুলও বাইরে থেকে বাসায় ফেরেন।

স্বজনেরা বলেন, একটা ঘরের মধ্যে তিন তিনজনের প্রাণ নেওয়া হলেও পাশের ঘরে থেকেও তাঁরা কিছুই শুনতে পাননি। প্রতিবেশীরাও বলছেন, তাঁরা কোনো চিৎকার বা ধস্তাধস্তির শব্দ পাননি। এসব কারণে জেসমিন আত্মহত্যা করেছেন ধারণা করছেন তাঁরা। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে যে ছুরিটি পাওয়া গেছে, সেটি এ বাড়িতে আগে দেখা যায়নি।

নিহতের স্বামীর ভাগনে রওশন জামিল বলেন, জেসমিনের এর আগেও অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়েছিলেন। পরে তাঁরা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। একবার কীটনাশক পানের চেষ্টা করে ধরা পড়েছিলেন তিনি। তাঁর ধারণা, শিশু দুটিকে আগেই খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল। তা নাহলে শিশু দুটির চিৎকার শোনো যেত।

হিমির বইখাতা । ছবি: সংগৃহীত

হিমির বইখাতা । ছবি: সংগৃহীত

জেসমিনের খালাতো বোন রেহানা বলেন, জেসমিন বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। তাঁর চিকিৎসাও চলছিল। তিনি সব সময় বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করতেন। চাকরি করে বাচ্চাদের যত্ন নিতে সমস্যা হচ্ছে বলে অন্যদের জানাতেন। সব স্বজনই তাঁকে চাকরি ছাড়ার কথা বলতেন। কিন্তু তিনি নিজেই আরও কিছুদিন চাকরি করার কথা বলতেন। রেহানারও ধারণা, শিশু দুটিকে হত্যা করে জেসমিন আত্মহত্যা করেছেন।

ওই কলোনির এক দোকানি আবদুল আহাদ বলেন, জেসমিন আক্তার ও তার বাচ্চারা বাকিতে বিভিন্ন জিনিস নিতেন তাঁর দোকান থেকে। সময়মতো পরিশোধ করতেন। জেসমিন আক্তার লেনদেনে খুব স্বচ্ছ ছিলেন। জেসমিন আক্তারের কাছে এখনো ৮০ টাকা বাকি রয়েছে। আহাদ মনে করেন না, ওই টাকার কথা বিবেচনায় না দিয়ে জেসমিন আক্তার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, মা তার দুই মেয়েকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছেন।

আরও তদন্তের পর বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে। রক্ত মাখা ছুরিসহ বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। আর ময়নাতদন্তের জন্য লাশ তিনটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

আশপাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা বলছেন, পরিবারটি বেশ হাসিখুশি ছিল। দেশে এবং ভারতে জেসমিনের মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসা চলছিল বলে সবাই জানতেন।

জেসমিন ও তাঁর স্বামীর গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার ভজনপুরে।

Prothom alo