অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার

মানবস্বাস্থ্য তথা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে রোগ-জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যাপকভাবে বলতে গেলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের আবিষ্কার একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃত। মূলত ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল’ বলতে আমরা মানব দেহে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু তথা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক কিংবা পরজীবীর বিরুদ্ধে কার্যকর, প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বা কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা ওষুধকে বুঝি। ১৯২৮ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কারের পর থেকে এর যথাযথ ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবন হয়ে উঠেছে অনেকটা নিরাপদ ও শঙ্কামুক্ত। অন্য দিকে, দীর্ঘ দিন থেকে এর অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের ফলে রোগ-জীবাণু হয়ে উঠেছে এর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধপ্রতিরোধী। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যা অ্যান্টিবায়োটিক তথা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স নামে পরিচিত।

জরিপে দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রাথমিক পর্যায়ে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের ৩ শতাংশ বহু ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। আর যেসব যক্ষ্মারোগীর আগে চিকিৎসার ইতিহাস রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই হার ১৫.৪ শতাংশ। আগে গনোরিয়া নামক মারাত্মক যৌনরোগের বিরুদ্ধে কার্যকর সিপ্রোফ্লক্সাসিন ওষুধ বর্তমান প্রায় অকার্যকর। ৭৫ শতাংশ টাইফয়েড জ্বরের জীবাণু আজ উপরিউক্ত ওষুধরোধী। বহু ওষুধরোধী টাইফয়েড, কুইনিনপ্রতিরোধী ম্যালেরিয়া, কিংবা বর্তমানে ওষুধরোধী কালাজ্বর আমাদের দেশ তথা সারা বিশ্বে হয়ে উঠেছে এক জ্বলজ্যান্ত আতঙ্কের নাম। গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে টেট্রাসাইক্লিনপ্রতিরোধী কলেরার জীবাণু। আইসিইউ তথা মুমূর্ষু রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের ৫০ শতাংশ রোগী কোনো না কোনো প্রকার, এক বা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক রোধী জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত। দেশে-বিদেশে অ্যান্টিভাইরালরোধী ইনফ্লুয়েঞ্জার দৌরাত্ম্য। উন্নয়নশীল বিশ্বের ৭ শতাংশ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল ওষুধরোধী।

মূলত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের বিরুদ্ধে জীবাণুর প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করা প্রকৃতির এক স্বাভাবিক ও মন্থর প্রক্রিয়া। কিন্তু রোগ-জীবাণুর জেনেটিক পরিবর্তন তথা মিউটেশন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের অনুমাননির্ভর, অপরিমিত ও নির্বিচার ব্যবহার, রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক যথাযথ মাত্রা ও সময়ব্যাপী চিকিৎসা না নেয়া, তৃণমূলপর্যায়ে হাতুড়ে চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ব্যক্তিগভাবে চিকিৎসা নেয়া, বাজারে ভেজাল ও নকল কিংবা বাতিলকৃত ওষুধের উপস্থিতি, কোনো ক্ষেত্রে বেআইনিভাবে ওষুধ কোম্পানি কর্তৃক ভুল তথ্য-উপাত্তের ফুলঝুরিতে চিকিৎসক তথা রোগীদের ওষুধ প্রদান কিংবা কেনার জন্য আকৃষ্ট করা, চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগ নিয়ন্ত্রণের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা, সর্বোপরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহারসংক্রান্ত যথাযথ নীতিমালা না থাকা, প্রভৃতি এই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স প্রক্রিয়াকে আরো ব্যাপক ও ত্বরান্বিত করে চলেছে। অন্য দিকে পশুপালন ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত খাদ্যের মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকরোধী জীবাণু মানুষের দেহে সহজেই প্রবেশ করে।

তা ছাড়া, কমিউনিটি পর্যায় থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালরোধী জীবাণু আক্রান্ত রোগী থেকে কোনো সুস্থ ব্যক্তির দেহে ওই জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটছে ব্যক্তি থেকে সমাজে; কিংবা সমাজ থেকে তা রাষ্ট্র হয়ে সমস্ত বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি করছে এক মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার। এর ফলে উপরোক্ত জীবাণুর চিকিৎসায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে আগে ব্যবহৃত অনেক ওষুধ। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আরো দামি ও তুলনামূলকভাবে অধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াযুক্ত ওষুধ। বেড়ে যাচ্ছে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়, রুগ্নতা ও মৃত্যুর হার। কমে যাচ্ছে মানুষের উৎপাদনশীলতা; চাপ বাড়ছে রাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। মানব সভ্যতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয়া এই সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনা করে ২০০১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলো এর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বিশেষ কর্ম-পরিকল্পনা। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর নভেম্বর মাস থেকে পালন করে আসছে অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা বিষয়ক সপ্তাহ, যার মূল প্রতিপাদ্য : সতর্কতার সাথে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিসট্যান্স যেহেতু আমাদের দেশসহ সারা পৃথিবীতে আজ এক মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে, তাই এর প্রকোপ ও বিস্তার প্রতিরোধ তথা নিয়ন্ত্রণকল্পে নিম্নলিখিত পন্থাগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমন- ব্যক্তিগতপর্যায়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো অ্যান্টিবায়োটিক তথা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের ব্যবহার নয়; চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক সঠিক মাত্রা ও সময়ব্যাপী প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন; কোনো সংক্রামক রোগে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের আগে সম্ভব হলে ওই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতা যথাযথ নিরূপণপূর্বক তা কার্যকর বলে প্রমাণিত হলে, তবেই তা ব্যবহার করা উচিত, অন্যের ব্যবহার করা অ্যান্টিবায়োটিক কখনো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে একই রোগে আক্রান্ত মনে করে, ব্যবহার করা অনুচিত। প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে উত্তম পন্থা।

তাই সংক্রামক রোগের চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধকল্পে নানা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যেমন- বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে শিডিউল মোতাবেক টিকা নেয়া, নিয়মিত হাত পরিষ্কার রাখা, নিরাপদ যৌনমিলন, খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও রান্নার সময় যথাযথ স্বাস্থ্যসম্মত বিধি অনুসরণ করা, ইত্যাদি গ্রহণ করা যেতে পারে। পরিহার করতে হবে অ্যান্টিবায়োটিকযুক্ত সব প্রানীজ খাবার। প্রয়োজনে সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগী থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিংবা সংক্রামক রোগীর সংস্পর্শে আসার ক্ষেত্রে, রোগের বিস্তার প্রতিরোধকল্পে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরিধান করা যেতে পারে। অপ্রয়োজনে কিছু সাধারণ রোগ যেমন- ভাইরাস জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া কিংবা সর্দিতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা একেবারেই অনুচিত। প্রয়োজনে রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক ও এর যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের ক্ষতি তথা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স সম্পর্কে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকসহ সরকার ও গণমাধ্যম দেশসহ সারা বিশ্বে এ ব্যাপারে ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করতে পারে।

বাজারে হাতুড়ে চিকিৎসকসহ সব ধরনের ভেজাল ও নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণকল্পে স্বাস্থ্য ও ওষুধ প্রশাসনের সাথে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক অভিযান চালাতে হবে। বন্ধ করতে হবে ওষুধ ব্যবহারের ভুল তথ্য সম্বলিত সব প্রচারণা। পশুপালন শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার পরিহার করতে হবে এবং গবাদি পশুর চিকিৎসায় রোগ প্রতিরোধকল্পে টিকাদান ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায়, ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন রোগের জীবাণুর বিরুদ্ধে আরো অধিক কার্যকর ওষুধ, টিকা কিংবা রোগের যথাযথ নিরূপণের জন্য আরো অধিক সংবেদনশীল পদ্ধতি আবিষ্কারের লক্ষ্যে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। হাসপাতালসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে রোগ নিয়ন্ত্রণসহ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। কোনো অ্যান্টিবাইক্রোবিয়ালের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম জীবাণুর উপস্থিতি ও এর বিস্তার নিয়ন্ত্রণকল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক তথা ল্যাবরেটরিগুলোর তদারকি ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে।

সর্বোপরি, আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিক তথা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের যথাযথ ব্যবহারের জন্য জাতীয় পর্যায়ে অ্যান্টিবায়োটিক তথা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও এর ব্যবহারের নীতিমালা আজ সময়ের দাবি। কেননা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়াতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। কাজেই এই সমস্যার প্রতিরোধকল্পে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখনই যদি সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ না করা হয় তবে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের মানবসভ্যতার পরাজয় ঘটতে পারে। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীর ভাষায় তখন সারা পৃথিবী হয়ে উঠবে মানবশূন্য এক বিরানভূমি, যেখানে চলবে শুধু জীবাণুর দৌরাত্ম্য। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি হবো জীবাণুর শিকার, না রোগ-জীবাণু থাকবে আমাদের যথাযথ নিয়ন্ত্রণে?

লেখক : মেডিসিন ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
E-mail: kafil_cmc@yahoo.com

Naya Diganta