এখনো নিশ্চিত হয়নি শ্রমিকের অধিকার

আর এক দিন পরই মে দিবস। অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশে শ্রমিক অধিকার আদায়ে পালিত হয় মে দিবস। কিন্তু শ্রমিকেরা কি তাদের অধিকার পাচ্ছেন? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকেরা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের অধিকার থেকে। এসব নিয়ে লিখেছেন
আব্দুর রাজ্জাক

মহান মে দিবস। মেহনতি ও শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের দিন। বঞ্চনা, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রাম আর অধিকার আদায়ের রক্তাক্ত গৌরবময় দিন। ইতিহাসের পাতায় মে দিবস উজ্জ্বল হয়ে থাকলেও আজো শেষ হয়নি বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত শ্রম পরিবেশ ও শ্রমিকের অধিকার বাস্তবায়ন হয়নি।

এক দিকে অধিকারবঞ্চিত শ্রমিকদের আন্দোলন; অন্য দিকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ তথা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ শ্রমিক জানেন না তাদের অধিকার। মে দিবস কাকে বলে তা বোঝেন না ওরা। জানেন না এই দিবসের পটভূমি, কর্মসূচি ও তাৎপর্য। তারা বোঝেন এক দিন কাজ না করলেই না খেয়ে থাকতে হবে। জীবন-জীবিকার টানে কেউ মাটি কাটছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গড়ে তুলছেন সুউচ্চ অট্টালিকা আবার কেউ ইটভাটার আগুনের সাথে করছেন সংগ্রাম। এ রকম নানা কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় শ্রমিকেরা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের অকান্ত শ্রম। ল্য একটাই সারা দিন রোদে পুড়ে হাড়ভাঙা খাটুনির পর একমুঠো চালডাল নিয়ে বাড়ি ফেরা।

ঘিওর উপজেলার গোয়ালডাঙ্গী গ্রামের মো: চুন্নু মিয়া নির্মাণশ্রমিক। ভোরে এসেছেন কাজে। মে দিবসে সব বন্ধ থাকে, এটা শ্রমিকদের দিবস, এই দিনটিতে কী করবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু মিয়া বলেন, মে দিবস কি আমাগো খাইবার (খেতে) দিবো? কাজ না করলে পরিবার নিয়ে খামু কী?
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা মে দিবসের সেই আন্দোলনের ফল এখনো পাননি। শ্রমিক দিবসের অধিকার আদায়ে রাজপথে অনশনে থাকেন বেকার নার্সেরা। গার্মেন্টে এখনো ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

বেসরকারি কারখানায় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি ৮ ঘণ্টার শ্রমসীমা। এখনো বেতন-বোনাসের বকেয়া টাকার জন্য করতে হচ্ছে আন্দোলন। যাদের শ্রমঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল, সেই শ্রমিকদের নেই কর্মক্ষেত্রের নিশ্চিত কোনো সুরক্ষাব্যবস্থা। জনবহুল রাস্তার মোড়ে প্রতিদিনই বসে শ্রমিক কেনাবেচার হাট। দেশের প্রায় সবপর্যায়ের শ্রমপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আন্তর্জাতিক মহলে।
টানা ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাদের। নেই কোনো নিয়োগপত্র, কোনো কর্মসীমা, কোনো সাপ্তাহিক ছুটি নেই, শ্রমিক রেজিস্ট্রার, নেই ছুটির রেজিস্ট্রার, নেই ছুটির বহি, নেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ। শ্রম অধিকার সম্পর্কে এ রকম অন্ধকার রয়েছেন মানিকগঞ্জের বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করা হাজারো শ্রমিক। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মালিকপ শ্রমিকদের বেতন বকেয়া রেখে উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চায়। এ নিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় দ্বন্দ্ব দেখা যায়।

তা ছাড়া আমাদের দেশে শ্রমিকদের একটি বড় অংশ নারী ও শিশু। এসব নারী ও শিশু বিভিন্ন কলকারখানা, বিশেষ করে গার্মেন্ট শিল্পে তারা বেশি কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের সংবিধানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তবু বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই আবার জীবন ঝুঁকির মধ্যেও পড়ে যাচ্ছে। মারাও যাচ্ছে অনেক শ্রমিক।
বাংলাদেশের শ্রমিকেরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা শারীরিক-মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। শিাসহ বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা হচ্ছে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরা। এসব শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাবে একসময় অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। তা ছাড়া প্রায় প্রতি বছর গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোয় বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এসব দুর্ঘটনায় অনেক নারী-পুরুষ-শিশু মারা যায়। দুর্ঘটনায় যেসব শ্রমিক মারা যায়, তাদের পরিবারের রুটি-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে।

শ্রমজীবী মানুষের এই স্বীকৃতির সূচনা সহজ ছিল না। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এই দিনে বুকের রক্তে শ্রমিকেরা আদায় করেছিলেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই সেদিন মালিকেরা স্বীকার করেছিলেন শ্রমিকেরাও মানুষ। তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। রক্ত দিয়ে কেনা দিনটিকে বিশ্বে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয়। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেঁধে দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। ১৯৮০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

১৮৯০ সালের ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মে দিবস শ্রমিকদের একটি বড় বিজয়। রক্তয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকেরা বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেছে।
যদিও শ্রম আইনে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, ছবিসহ পরিচয়পত্র, সার্ভিস বহি প্রদান, রেজিস্ট্রার সংরণ, ছুটির রেজিস্ট্রার সংরণ, ছুটির বহি প্রদান, সাপ্তাহিক ছুটি, ওভারটাইম রেজিস্ট্রার, দৈনিক রেজিস্ট্রার রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত ইটভাটা কিংবা নির্মাণশ্রমিকদের জন্য কার্যকর হয়নি। বছর ঘুরে আবার খেটে খাওয়া মানুষের স্বপ্ন সার্থকতার দিন মহান মে দিবস আসে। তবে আর দশ-পাঁচটা দিবসের মতো আপামর বাঙালির জীবনে এ নিয়ে তেমন কোনো উচ্ছ্বাস নেই। থাকার কথাও নয়। এখানে মে দিবস আসে নেহাত ৩০ এপ্রিলের পরের দিন ১ মে, সেই হিসেবে। ওই দিন সরকারি ছুটি থাকে। কিন্তু শ্রমিকেরা জানেন না, এই দিনটা শুধুই তাদের জন্য। তাদেরকে ও কাজকে সম্মান করার জন্য এই দিনের আয়োজন। অথচ তাদের নেই ছুটি, এ দিনেও তাদের ছুটতে হয় কাজে। মাথায় তুলতে হয় ইটের পরে ইট।

কথা হয় সদর উপজেলার গড়পাড়া ঘোনা গ্রামের ভাটা শ্রমিক আছিয়া বেগমের সাথে। তিনি জানালেন, ‘ইটভাটায় কাজ করা আর জাহান্নামের আগুনে পোড়া সমান কথা। লম্পট স্বামী দু’জন পোলাপান আমার ঘাড়ে দিয়া আরেকটা বিয়া করছে। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাইয়া আগুনে পুড়ে কাজ করতে অয়। শ্রম দিবস কী এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। শুধু জানালেন, এক দিন কাজ বন্ধ থাকলে সেদিন না খেয়ে থাকতে হবে। যাত্রীবাহী সিএনজিচালক চান মিয়া ও বাসচালক মো: আসলাম বলেন, মে দিবস আছে কিন্তু ওই দিন কী হয় তা জানি না। শুধু জানি, একদিন যদি গাড়ির চাকা না নড়ে, তাহলে আমাদের পেটে টান পড়ে।

কিন্তু যে শ্রমিকটি প্রচণ্ড রোদে গাধার খাটুনি খেটে চলেছে, খুব ভোরে উঠে যার দিন শুরু, আবার রাতে সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে যার ঘুমানোর সময়, তার জন্য আট ঘণ্টার মহান মে দিবস নেই। সে জানেও না আট ঘণ্টা মানে কত ঘণ্টা? ট্যানারির নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যাওয়া গন্ধময় পরিবেশে যেসব শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের সাথে যে শিশু শ্রমিক নোংরা ময়লা ঘেঁটে জীবনের সুকুমার শৈশবকে মাটিচাপা দিচ্ছে, কাঁচা ইট জ্বালানো কিলিংয়ের আগুনের ওপর দাঁড়ানো যে শ্রমিকের মুখ সারাণই লাল হয়ে জ্বলছে, ভাটায় মায়ের সাথে ইট কাটছে যে কচি শিশুটি তার কাছেও মে দিবস কোনো গুরুত্ব নেই। সে জানে তার হাতে ধরা ফর্মা বেসামাল হলেই আর এক হাতে পড়বে! চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবে।

মানিকগঞ্জ নির্মাণশ্রমিক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: আনোয়ার হোসেন বলেন, যেসব শ্রমিকের পরিশ্রমের ফলে এই দেশ আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সেই শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের পারিশ্রমিকে যে বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করতে হবে। তিনি আরো বলেন, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের টাকায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। আর মেহনতি শ্রমিকেরাই করছে মানবেতর জীবনযাপন।

আসলে আমরা শ্রম বা শ্রমিকের মর্যাদা বুঝেও বুঝতে চাই না। একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যা যা প্রয়োজনÑ অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাÑ এসবই একজন শ্রমিকের প্রাপ্য। আর এটাই হচ্ছে শ্রমিকের প্রকৃত মর্যাদা। একুশ শতকে এসে শ্রমিকেরা এর কতটুকু মর্যাদা বা অধিকার ভোগ করছে? বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রোপটে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে। কারণ শ্রমিকেরা এ দেশের সম্পদ। তাদের কারণেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। এ কারণে তাদের অবহেলার চোখে দেখা ঠিক নয়। পাশাপাশি তাদের কাজের ও জীবনের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। মহান মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
Naya Diganta