বিএনপিকে মামলায় ব্যাস্ত রেখে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা ঠিকিয়ে রাখতে যে জনগণের পাশাপাশি প্রতিবেশীদের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি তা ভালো করেই জানে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। কংগ্রেস-আওয়ামী লীগ সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর, এখন ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গেও যোগাযোগ বেড়েছে। পক্ষান্তরে বিএনপি সেই দৌড়ে অনে পেছনে।
রোববার বিজেপির আমন্ত্রণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারত সফরে গেছে। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। নির্বাচনের বছরে আওয়ামী লীগের এ কূটনীতিক তৎপরাতা সবারই নজর কেড়েছে। এ সফরের দিকে ঈগল দৃষ্টি রেখেছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরাও। তারা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত সবসময়ই একটি বড় ফ্যাক্টর। তাই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের এই মিশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এর কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ভারতের কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে অংশ নেয়। তারা ওই সময় কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়, সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে কথাও বলেন ওই দলের সদস্যরা।
আওয়ামী লীগের বর্তমান ভারত সফর নিয়ে ওই দেশেও চলছে নানা হিসাব-নিকাষ। সেটাই তুলে ধরেছেন ভারতের বিবিসি প্রতিনিধি শুভজ্যোতি ঘোষ। আওয়ামী লীগের গেল কাউন্সিলে বিজেপির যে প্রতিনিধি দলটি ঢাকায় এসেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন দলের ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিনয় সহস্রবুদ্ধে। তিনি বিবিসিকে বলেন,
‘দুই দেশে দুটি দলের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষাকে বিজেপি বরাবর খুব গুরুত্ব দেয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের এ সফর বিজেপির সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন।’ আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা শুধু কংগ্রেস এবং নেহরু-গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ, এটাকেও নেহাত একটা ভ্রান্ত ধারণা বলে মনে করেন তিনি।
বিজেপির এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলে, ‘একজন ব্যক্তি, দলনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা যে ভারত ও ভারতীয়দের কাছের মানুষ তাতে কোনো ভুল নেই। জীবনের একটা খুব কঠিন সময়েও তিনি ভারতের সাহায্য পেয়েছেন। কিন্তু সেটাকে যদি শুধু একটা দল বা পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল হবে!’
বস্তুত নরেন্দ্র মোদির গত চার বছরের শাসনে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে, তা এ দুই দলে অনেকেরই প্রত্যাশার বাইরে ছিল। এ বিষয়ে বিজেপির পলিসি রিসার্চ সেলের অনির্বাণ গাঙ্গুলি বলেন,
‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতির প্রভাবও পড়েছে দুই দেশের শাসক দলের সম্পর্কে। তবে বিজেপি সব সময় চায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, গণতন্ত্রের ধারা বহমান থাকুক, আর তার মধ্যে দিয়ে সে দেশের রাজনীতি এগিয়ে যাক। পাশাপাশি সেখানে গণতন্ত্র ধ্বংসকারী শক্তিগুলো যেন পরাস্ত হয়।’
বিনয় সহস্রবুদ্ধের সুরে সুর মিলিয়ে তিনিও বলেন, ‘একটা ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ ভারতে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ, ব্যাপারটা আদৌ সেরকম কিছু নয়। ভারতে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকুক, আমরা সব সময় চেয়েছি পররাষ্ট্রনীতিতে একটা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে। বিজেপিও বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগকে সেই দৃষ্টিতেই দেখে এসেছে।’
কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিজেপির এই নিবিড় সম্পর্কের পটভূমিতেই এ প্রশ্নটাও ওঠা স্বাভাবিক যে, নির্বাচনে ভারতের শাসক দল কি সেখানে প্রভাব খাটাতে উদগ্রীব? আওয়ামী লীগ নেতাদের সোমবার মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করছেন
বিজেপি নেতা ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এমজে আকবর, তিনি অবশ্য এ জল্পনা সোজা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তার সরল কথা, ‘আমরা কোনো দিনই কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাইনি, হস্তক্ষেপও করিনি। আমরা এটা বিশ্বাসও করি না, আর নিশ্চিন্ত থাকুন কোনো দিন করবও না।’
তবে এটাও ঠিক যে বাংলাদেশে এখনও প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত বিএনপির সঙ্গে বিজেপির কোনো সহজ, খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। অনির্বাণ গাঙ্গুলি তার কারণটা ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘আপনার হয়তো মনে আছে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি যখন বাংলাদেশ সফরে যান, খালেদা জিয়া এসে দেখাও করেননি।
সেটা ছিল পরিষ্কার কূটনৈতিক অসৌজন্য। তবে বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, আমরা সব সময়ই চাই সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে একটা ফ্রেমওয়ার্ক রেখে এগিয়ে যাক।’তিনি বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মত হল- বিএনপি যতক্ষণ না জামায়াত সম্পর্কে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করছে, ততক্ষণ সম্পর্কে একটা অস্পষ্টতা রয়েই যাবে। আমরা কেউই তো বিচ্ছিন্ন নই, প্রত্যেকেই আমরা একটা আঞ্চলিক যোগসূত্রে বাঁধা।
সেই সামগ্রিকতায় জামায়াতের পরিকল্পনা কী, বিএনপিই বা তাদের সম্পর্কে কী ভাবছে, এগুলো যতক্ষণ না পরিষ্কার হবে ততক্ষণ দীর্ঘমেয়াদে কোনো বন্ধনও গড়ে ওঠা সম্ভব হবে না।’
শুধু ভারত নয়, এশিয়ার অন্যতম পরাশক্তি চীন এবং দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গেও আওয়ামী লীগের সুসম্পর্ক। তবে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে এবং অর্থনৈতিক বিষয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে দেখে দলটি। অন্যদিকে বিএনপির কূটনীতিক পরিকল্পনা তো দূরে থাক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া নিয়েই বিভক্ত নেতারা।