আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাব? উত্তরে যা বললো সেনাবাহিনী-খুশিতে বিএনপি

সংসদের বাইরে থাকা অন্যতম বড় দল বিএনপিসহ ইসিতে নিবন্ধিত অধিকাংশ দল চাইলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আপত্তির কারণে নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে গ্রেপ্তার ক্ষমতা দিতে পারছে না নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য করতে ইসির পক্ষ থেকে বিশেষ এই বাহিনীটির ক্ষমতায়ন ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এলক্ষ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ (আরপিও) সংশোধনী এনে বিলুপ্ত বিধানটি (আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় ‘সশস্ত্র বাহিনী’ শব্দটি সংযোজন) যুক্ত করতে চায় কমিশন। বিষয়টিকে এজেন্ডায় রেখে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইসির সংলাপে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামতও নিয়েছে ইসি।

সংলাপে অংশ নেয়া প্রায় সবাই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীতার কথা তুলে ধরেন। আরপিও-তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় আইন সংশোধন করে সেনাবাহিনী অন্তর্ভুক্ত করেই হোক, কিংবা জরুরি তলবের মাধ্যমেই নির্বাচনী কাজে যুক্ত করা হোক, এই বাহিনীকে ভোটের সময়ে অবশ্যই মাঠে রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তারা। এনিয়ে চলতি মাসে গনমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সাথে অনুষ্ঠেয় সংলাপেও মতামত নেয়া হবে। সবশেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এনিয়ে আলোচনা করবে কমিশন। রাজনৈতিক সমঝোতা হলেই আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে। ইসি সচিবালয়ের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

ইসির আইন শাখার একজন কর্মকর্তা মানবকণ্ঠকে জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে পরিস্থিতি বুঝে বিশেষ প্রেক্ষাপটে মাঠে নামতে সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করতে হয়। এই বিধানটি যুক্ত করা গেলে যখন, যেখানেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, র্যাব, পুলিশ, বিজিবির মতো সেনাবাহিনীর সদস্যরাও মাঠে নেমে যাবে। পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার পর নয়; বরং নির্বাচনে কোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টিই যেন হতে না পারে সেলক্ষ্যেই এটি চায় কমিশন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা ছাড়া ইসি এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। সিদ্ধান্তটি নিতে সময় লাগবে। এ বিষয়ে যদি সব দলের ঐকমত্য থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশন পজিটিভলি চিন্তা করবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী (মূলত সেনাবাহিনী) তত্কালীন গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের (আরপিও) আওতায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অংশ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, অর্থাত্ ২০০১ সালের ৮ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আওয়ামী লীগের আপত্তি উপেক্ষা করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে পুলিশের সঙ্গে আনসার, বিডিআর, কোস্টগার্ড এবং প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলোকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

এর ফলে সেনাবাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশের মতোই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা লাভ করে। এর আগের কয়েকটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হলেও তখন তাদের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা ছিল না। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্যই তাদের মোতায়েন করা হয়।২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ আগের মতোই নির্বাচনী আইন সংস্কার প্রস্তাবে আরপিওতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলোকে বাদ দেয়ার দাবি জানায়। কিন্তু সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ ওই দাবি থেকে সরে এসে সংসদ নির্বাচনে সেনা নিয়োগকে সমর্থন জানায়।

তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলো বাদ দিয়ে বর্তমান সংসদে আরপিওর সংশোধন অনুমোদন হয়। আবার একই সময়ে অন্যদিকে উপজেলা পরিষদ ছাড়া সব স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) নির্বাচনী আইনে প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগগুলোকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশের পর থেকেই মূলত সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়। ইসির সংলাপ শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকছে বলে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য এবং পরে ইসি সচিবের অনুরূপ আভাসের মধ্য দিয়ে এই আলোচনা নতুন মাত্রা পায়। ওইদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন মনে করলে সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করবে। পরে বিকেলে নির্বাচন কমিশনের সচিবও সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে একই কথা বলেন। অবশ্য ওবায়দুল কাদের এবং কমিশন সচিব- কেউই আগামী জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী কী দায়িত্ব পালন করবে, তা স্পষ্ট করেননি। তবে নির্বাচন বিশ্লেষকরা যেকোনো প্রকারেই হোক ভোটে সেনা রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সেনাবাহিনীকে যদি ফিলিং স্টেশন, রাস্তা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যায়, তাহলে কেন নির্বাচনে দায়িত্বপালনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সবাই নির্বাচনে আসতে পারে। প্রার্থী, পোলিং এজেন্টদের ভয় দূর করতে হবে। ‘না’ ভোট প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, না ভোট যেন রাখা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে না ভোট আছে। তিনি বলেন, বিনা প্রতিদ্বনি্দ্বতায় নির্বাচনের কোনো সুযোগ যেন না থাকে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ছিল। পরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে ‘সশস্ত্র বাহিনী’র বিধান তুলে দেয়া হয়। তবে, নির্বাচনে দখলদারিত্ব, পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ এবং নির্বাচনে স্বচ্ছতা ফেরানোর স্বার্থে পুনরায় সেনাবাহিনীকে সংজ্ঞায়িত করে আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করাটা হবে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

উল্লেখ্য, সংসদ নির্বাচন পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এর আগেও বিভিন্ন সময় সংস্কার করা হয়। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিওতে বেশকিছু বিধান সংশোধন করা হয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর এই অধ্যাদেশ সংসদে পাস হয়। এ পর্যন্ত ১১ বার আরপিওতে সংশোধনী আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে অন্তত ২০৯টি বিষয়ে সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধন) আইন-২০১৩ বিল পাস হয়।