“সাজা বৃথা গেছে। জনগণের উত্তর – তিনি কোন অপরাধ করেননি। বন্দি বেগম জিয়া অনেক বেশি জনপ্রিয়।”

বেগম জিয়াকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। সরকার খুব আনন্দিত ও উৎফুল্ল। অনেক মন্ত্রী, এমপি, নেতাকর্মী তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রায় ঘোষণার দিন এক জনসভায় বলেন, কোথায় আজ খালেদা জিয়া? ক্রসফায়ারে সিরাজ সিকদার নিহত হবার পর প্রধানমন্ত্রীর পিতাও বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? দু’জনের উক্তির মধ্যে আশ্চর্যজনক মিল। খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণার পর মিষ্টি বিতরণ রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত। সম্ভবত সরকার যেন পণ করেছিল বেগম জিয়াকে শাস্তি দিতেই হবে।

তাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করতে পারলে তিনি বাংলাদেশের মানুষের নিন্দা ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হবেন। দেশ-বিদেশের মানুষের মন থেকে তাঁর নাম মুছে যাবে। মানুষের নিন্দা ও ঘৃণার পাত্রে পরিণত হলে তাঁর রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সরকারের অভিসন্ধি অসার প্রমাণিত হয়েছে।

বলা বাহুল্য, বেগম জিয়া বানে ভেসে আসা নেতা নন। দীর্ঘ সংগ্রাম, পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় তাঁকে নেতা বানিয়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসে তিনি নেতা হননি। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর রাজপথে থেকে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেছেন। স্বৈরাচারের সাথে কোনরকম আপোস না করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন থেকেছেন। কোনরকম লোভ লালসা তাঁকে কর্তব্যকর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। মানুষের ভোটাধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা না করে ঘরে ফিরেননি।

৯ বছরের মধ্যে সকল নির্বাচন বয়কট করে সাধারণ মানুষের কাতারে কাতারবন্দি থেকেছেন। কোনরকম প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদকে বৈধতা দেননি। ইচ্ছা করলে একটু আপোস করে চললে বেগম জিয়া ক্ষমতার ভাগ পেতেন একথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

কিন্তু তিনি ক্ষমতার লোভে বিবেক বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে গণতন্ত্র হত্যার কার্যক্রমে শরীক হননি। তাঁর ধ্যান জ্ঞান ও সকল কর্মকান্ড আবর্তিত হয়েছে গণতন্ত্র, গণতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। বিএনপির বহু বড় নেতা চাপে পড়ে এরশাদের দলে ভিড়েছেন যাতে দল অগোছালো ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীরা হতাশ ও নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। নির্বাচনে অংশ নিতে ঘরে বাইরের প্রচন্ড চাপ বেগম জিয়াকে টলাতে পারেনি। তিনি জানতেন, এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার অর্থ বিরোধীদলে জায়গা পাওয়া ও এরশাদকে বৈধতা দেওয়া। আওয়ামী লীগ ’৮৬ সালে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে এরশাদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠত।

এদেশের জনগণকে ’৯০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো না। তিনি সকল রকম প্রলোভন উপেক্ষা করে ’৮৬ সালের নির্বাচন বয়কট করে জাতীয় বেঈমান না হয়ে জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভ করেন। এদেশের জনগণের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বেগম জিয়া কালজয়ী রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন। এমনি এমনি তিনি তিনবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হননি। তাঁর সংগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছে।

বেগম জিয়াকে সাজা দিয়ে জেলখানায় রেখে সরকার ভাবছে খুব লাভবান হয়েছে। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষ প্রতিবাদ বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অনশন প্রভৃতি কর্মকান্ডর মাধ্যমে সরকারের হীন চক্রান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সাজার পর থেকে মানুষ রাস্তায় নেমে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়েও সরকার রাজনীতি করছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নয়াপল্টনে কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচি পুলিশী বাধায় পন্ড হয়েছে। বিনা উসকানিতে ব্যাপক লাঠিচার্জ ও পানিকামান ব্যবহার অন্যায়, অযৌক্তিক ও নিন্দাযোগ্য। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দেবার ঘোষণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিয়েই পুলিশ ক্ষান্ত হয়নি, সেখান থেকে খায়রুল কবির খোকনসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে মামলা দেয়া হয়েছে।

এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা ফ্যাসিস্ট সরকারের চরিত্র মনে করিয়ে দেয়। বিএনপি নেতাকর্মীদের সাথে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ এই প্রহসনমূলক বিচারের নিন্দা, ধিক্কার ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সমাজ বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন প্রভৃতি কর্মকান্ড সম্পন্ন করেছি। আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১১ থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি লাগাতার তিনদিন কর্মসূচি পালন করার পর আমার নিজ এলাকা জয়পুরহাটেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। জয়পুরহাটে দেখেছি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা আমাকে বিস্মিত ও হতবাক করেছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা না দেবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আমাদের পুলিশ বের হতে দেয়নি। পার্টি অফিসে গলির মধ্যে আমাদের বন্দি রাখা হয়েছে। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক বিক্ষোভ কর্মসূচিতে পুলিশের বাধা দেয়া অন্যায়, অযৌক্তিক ও অগণতান্ত্রিক। পার্টি অফিস থেকে বের হয়ে আমরা চিনিকলের রাস্তা ঘুরে আবার পার্টি অফিসে ফিরে আসার পরিকল্পনা নিয়ে বের হই। পুলিশ গলি থেকে বের হতে দেয়নি। পুলিশ বোধহয় চেয়েছিল আমরা একটু গোলমাল-হট্টগোল করি। চিনি কলের রাস্তাটি ছিল সম্পূর্ণ যানজটমুক্ত। আমাদের আশা ছিল, পুলিশ বাধা দেবে না। আমরা শান্তি বজায় রেখে সম্পূর্ণ শৃৃঙ্খলভাবে কর্মসূচি শেষ করে ফিরে আসব। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আমরা শৃঙ্খলভাবে ফিরে স্টেশনের দিকে যেতে চাই। কিছুদূর যেতে আবার বাধা। আমরা সাজানো ফাঁদে পা না দিয়ে গোলমাল-হট্টগোল না করে ফিরে এসে বক্তব্য দিয়ে শেষ করি।

২০ ফেব্রুয়ারি ডিসি সাহেবের পক্ষে এডিসি স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। সামান্য গোলমাল-হট্টগোল করলে পুলিশ মওকা পেয়ে সাজানো মামলা দিয়ে ধড়পাকড় শুরু করত। পুলিশের বাধা দেশের মুমূর্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে কলুষিত করছে। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরী ও শহীদ মিনারে ফুলদান কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয়নি। ওই ফুলদান কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে কোনরকম অশান্তি বিশৃঙ্খলাতো হয়নি। যানজটমুক্ত চিনিকল রাস্তা বা স্টেশন রোডে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে দিলে মহাভারত অশুদ্ধ হতো না বলে আমরা মনে করি। এতে সরকারের গণতান্ত্রিক চরিত্রের ছিটেফোটা হলেও প্রকাশ পেত। পত্রিকার খবরে প্রকাশ, দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে ও অনেক জায়গায় বহু নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাহোক, সরকার যেভাবে বিরোধীদলের উপর অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে তাতে তারা গণতান্ত্রিক সরকারের দাবি করতে পারে না। অনির্বাচিত স্বঘোষিত সরকার অবশ্য সে দাবিও করে না।

বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ফাঁকে আমি গ্রামে যাই। জয়পুরহাট থেকে যেতে রাস্তায় ২/৩ দিন কয়েক জায়গায় দোকানে বসি। আমাকে দেখে অনেক লোক জড়ো হয়। আমি বেগম জিয়া সম্পর্কে জনগণের মনোভাব যাচাই করার জন্য বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করি। জনগণের উত্তর হলো, তিনি কোন অপরাধ করেননি। একজন উস্কো খুশকো চুলদাড়িয়ালা লোক খেপে উঠে বললেন, টাকা তো খরচই হয়নি, দুর্নীতি হয় কীভাবে? দু’কোটি টাকা ছ’কোটি হয়েছে। টাকা খরচ না হলে দুর্নীতির প্রশ্ন অবান্তর। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের জন্য বগুড়ায় জমি কেনা হয়েছে। বাকী টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনদিন ধরে বিভিন্ন স্পটে ও আমার গ্রামে জনমত যাচাই করে আমি নিশ্চিত হয়েছি, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাজা বৃথা গেছে।

মানুষ বেগম জিয়াকে সৎ, নিষ্পাপ, নিরপরাধ ও ষড়যন্ত্রের শিকার বলে বিশ্বাস করে। আমার মনে হয়েছে, মুক্ত বেগম জিয়ার চেয়ে বন্দি বেগম জিয়া অনেক বেশি জনপ্রিয়। তাঁর প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বেগম জিয়া নাকি আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। এরকম বানোয়াট ও অসত্য কথা দেশের একজন মানুষও বিশ্বাস করে না। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিও আদালতে বলে আমি নির্দোষ। একজন পাগলকে জিজ্ঞেস করলেও পাগল বলবে আমি নির্দোষ। আমাদের গ্রামের পাশে একজন দুধর্ষ ডাকাত ছিল। ডাকাতের মা একবার আমাদের বাড়িতে আসে। বাবা কি মনে করে তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার ছেলেকে ভালো হতে বলতে পার না?

ওর মা সাথে সাথে উঠানে ধানের স্তূপ থেকে এক মুষ্ঠি ধান নিয়ে শপথ করে বলতে থাকে ‘আল্লাহর কসম, আমার ছেলে চুরি-ডাকাতিতে জড়িত নয়। মানুষ হিংসা করে তার নামে বদনাম দেয়।’ ব্যাপারটি আমার চোখের সামনে ঘটে। প্রিয় পাঠক, একজন মার্কামারা অপরাধীর মা শপথ করে ছেলের অপরাধ অস্বীকার করে। বেগম জিয়া অপরাধ না করেও অপরাধ স্বীকার করে নেবেন একথা একজন পাগলও বিশ্বাস করবে না। জয়পুরহাটে আমার গ্রামে যাবার সময় এক লোক বলে, দুর্নীতি করে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে টাকা কামায় করতে হবে না। তিনি চাইলে একদিনেই কোটি কোটি টাকা যোগাড় হবে। আমি গরীব মানুষ ম্যাডাম চাইলে ১০০০ টাকা আমিও দেব।

বেগম জিয়ার সাজা তাঁকে আপোসহীন নেত্রী থেকে বঙ্গজননীতে রূপান্তরিত করেছে। ব্যাপক জনপ্রিয় এই নেতার কারাবাস আমাদের ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। এ কারাবাস এদেশের মুমূর্ষ গণতন্ত্রকে চারদেয়ালে বন্দি করেছে। আমরা তাঁর দুঃখকষ্টে সমব্যাথী। আশার কথা উচ্চ আদালত বেগম জিয়ার আপিল গ্রহণ করেছেন অর্থদন্ড স্থগিত করে। অন্যদিকে রায়ের সার্টিফায়েড কপি পেতে ১৩ দিন লেগেছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা অশা করি, উচ্চ আদালত সামগ্রিক অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে আসার সুযোগ দেবেন।

২০১৪ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন দেশ-বিদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আর দেখতে চায় না। দেশের অর্থনীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে চলেছে। দেশকে মেধাশূন্য করে পঙ্গুত্বের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। লেখাপড়া বলতে কিছু নেই। প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে জাতি মেধাশূন্য হয়ে মূর্খজাতি হিসেবে পরিচিতি পাবে, যা একটি দেশ ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। এসব ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড প্রতিরোধে সরকার সর্বোচ্চ মনোযোগ দিক,

জনগণ সেটাই প্রত্যাশা করে। উন্নয়নশীল অর্থনীতি ও অনুন্নয়নশীল গণতন্ত্র সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। এতে ভঙ্গুর উন্নয়ন ও নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়। দলীয় স্বার্থে মোহান্ধ না হয়ে নিজেদের কল্যাণ পরিত্যাগ করে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ পরিবেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চাওয়ায় লাভ হবে না। সুজন সত্যিই বলেছে, আর একবার ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করতে চাইলে দেশের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।

সবাইকে জানিয়ে দিতে নিউজটি অবশ্যই শেয়ার করুন

ড. আব্দুল হাই তালুকদার