জামায়াতের ছাড়, স্বস্তিতে বিএনপি

অভ্যন্তরীণ দূরত্ব কমিয়ে রাজনীতির চাওয়া-পাওয়ার আলোকে কাছে এসে মেয়র পদে নিজেদের গুরুত্ব বুঝিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বাধ্য করে বেশ কিছু কাউন্সিল পদ ছিনিয়ে নেওয়া, নাকি জামায়াতের এটা নতুন কৌশল—এ নিয়ে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী আগামী ১৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে
(প্রিয়.কম) গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে ফের আলোচনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এবার জামায়াতের মূল প্রতিপক্ষ খোদ জোটপ্রধান বিএনপিই। যদিও জোটে থেকে মেয়র পদে সমঝোতায় নিজেদের অবস্থান নতুন করে জানান দিয়েছে দলটি।

হঠাৎ এ ধরনের ছাড়ে খানিকটা স্বস্তি এলেও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থেকে পর্যবেক্ষণ করছে বিএনপি। অভ্যন্তরীণ দূরত্ব কমিয়ে রাজনীতির চাওয়া-পাওয়ার আলোকে কাছে এসে মেয়র পদে নিজেদের গুরুত্ব বুঝিয়ে চাহিদা অনুযায়ী বাধ্য করে বেশ কিছু কাউন্সিলর পদ ছিনিয়ে নেওয়া, নাকি জামায়াতের এটা নতুন কৌশল—এ নিয়ে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরামে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শরিক জামায়াতে ইসলামী। তাই হঠাৎ করে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল ও সমঝোতার ধরন নিয়ে বিএনপিকে সাময়িক হলেও কিছুটা ভাবাচ্ছে। কেননা ইতোমধ্যে জামায়াতের পক্ষ থেকে আওয়াজ দিয়ে রাখা হয়েছে এই মর্মে যে, তারা গাজীপুর সিটিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও আসন্ন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জোটের মনোনয়ন চায় দলটি এবং সেই দাবিতে শেষ পর্যন্ত অনড় অবস্থানে থাকবেও জামায়াত। এমনকি তাদের নেতাদের কাছ থেকে জোরালো দাবি উঠেছে, বিএনপিকে সিলেটে অন্তত জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দিতেই হবে।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিএনপির রাজনৈতিক চলার পথে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও ভোটবন্ধু জামায়াতে ইসলামী। গত শুক্রবার জোটের বৈঠকে জামায়াত ইসলামীকে ডাকা হয়নি কথাটা সঠিক নয়। মোট কথা হচ্ছে, জোট বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে যিনি অংশগ্রহণ করে থাকেন, তিনি হয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই আসতে পারেননি। কারণ তিনিই (আব্দুল হালিম) তো জামায়াতের বড় নেতা নন। তার চেয়ে অনেক বড় নেতারা রয়েছেন। তিনি তো মাত্র কর্মপরিষদের সদস্য ‘

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামী কি না—এমন প্রশ্নে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ থাকে, কিন্তু এই মুহূর্তে অন্ততপক্ষে বিএনপির প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামী নয়। বরং বিএনপির প্রতিপক্ষ তারাই, যারা বিনা ভোটে রাষ্ট্র পরিচলানায় এসে দেশ থেকে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে।’

নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘গাজীপুর সিটিতে মেয়র পদে ২০ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তই জামায়াতে ইসলামীর সিদ্ধান্ত। মেয়র পদে তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই, হয়তো কিছু কাউন্সিলর পদে তাদের চাওয়া-পাওয়ায় থাকতে পারে। সেটা নিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগও অব্যাহত আছে। এতে কোনো সমস্যা হবে বলে আমি মনে করি না, ঠিক হয়ে যাবে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রিয়.কমকে বলেন, ‘একদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক চাপ, অন্যদিকে জোটপ্রধান কারান্তরীণ খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপির কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টিতে হয়তো রাজনীতিতে অনেকটাই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে দলটি। ফলে সংগঠনটিকে বেশ কিছুদিন ধরে অভ্যন্তরীণ কোণঠাসা কাটিয়ে উঠতে একলা সময় পাড়ি দিতে হচ্ছে। সে জন্য তারা অনেকটাই কৌশলে বিএনপি থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে।

শুধু তা-ই নয়, আমরা এমন কথাও শুনতে পাচ্ছি, প্রয়োজনে জামায়াতে ইসলামী নাকি স্বতন্ত্র প্রার্থীর মাধ্যমে আগামী দিনে পথ চলতেও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় হয়তো যখনই সুযোগ পাচ্ছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে, সেখান থেকে পিছপা হচ্ছে না দলটির নেতৃত্ব। যেমনটি দেখা গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপ-নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এবং সর্বশেষ গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে। যে কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের পক্ষ থেকে একক প্রার্থীকে মনোনীত করার পরও তারা (জামায়াতে ইসলামী) প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে গড়িমসি শুরু করে।’

এদিকে জামায়াত-সমর্থিত প্রার্থী এস এম সানাউল্লাহ প্রিয়.কমকে বলেন, ‘রাজনীতি করি, প্রার্থী হতেই পারি, এতে দোষের কিছু নেই। দলের সিদ্ধান্তে প্রার্থী হয়েছি, আবার দল ও জোটের সিদ্ধান্ত মেনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। তবে নিশ্চয়ই কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে এস এম সানাউল্লাহ বলেন, ‘ভোটের ঐক্যের ক্ষেত্রে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সহজে চির ধরানো সম্ভব নয়। সময় হলে আরও অনেক কিছুই দৃশ্যমান হবে। অপেক্ষায় থাকুন।’

দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত জামায়াতে ইসলামী। তবে সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করার পর ফের নড়েচড়ে বসেছে দলটির নেতৃত্ব ও তাদের রাজনীতি। আর তাই তো ঢাকার মতো গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি ও জোটের সিদ্ধান্তের আগ থেকে জামায়াতে ইসলামী তার দলীয় প্রার্থীকে প্রচারণায় নামিয়ে দিয়েছে। যা তাদের ডাবল স্ট্যান্ডবাজি ছাড়া কিছুই হতে পারে না। আর এতেই শুরু হয় ২০ দলীয় জোটে মতবিরোধ এবং এবার সেই মতবিরোধ এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছে যে, সর্বশেষ জোট শরিকদের মিটিংয়ে জামায়াত ইসলামীকে না ডাকতে বাধ্য হয়েছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের একাধিক নেতা আলাপকালে প্রিয়.কমকে এমনটাই জানিয়েছেন।

এ সম্পর্কে জোট শরিক বাংলাদেশ ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া প্রিয়.কমকে বলেন, ‘আমার জানা মতে বিএনপির পক্ষ থেকে ২০ দলীয় জোটের শরিক সকল দলকেই গত বৈঠকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি সেই বৈঠকে ছিল না। কেন ছিল না সেটা জানি না।’

এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহাবুবুর রহমান প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিএনপির সাথে জামায়াত এবং জামায়াতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক আগে যেমন ছিল, জোটপ্রধান খালেদা জিয়া কারান্তরীণ হওয়ার পরও একই অবস্থানে রয়েছে। কোনো দূরত্ব আছে বলে মনে হয় না। কাজেই সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির নতুন করে স্বস্তি পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া আমি মনে করি ভোট শরিক বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যেটা দৃশ্যমান, সেটা রাজনৈতিক কৌশল ছাড়া কিছুই নয়।’

বিএনপি নেতাদের মতে, ২২ এপ্রিল, শনিবার বিএনপি-জামায়াত ইস্যুতে বৈঠক করেছে বিএনপির নীতি নির্ধারণী ফোরাম। স্থায়ী কমিটির বৈঠক থেকেই প্রার্থী-জটিলতা দূর করতে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিএনপি এবং ফোনালাপের মধ্য দিয়েই দুই দলের অবস্থানের সমাধান হয়। বৈঠকে জামায়াতকে কিছু কাউন্সিলর পদে ছাড়ের বিনিময়ে মেয়র পদে ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে জামায়াত। এমনটা মেনে নিয়েই গাজীপুর সিটিতে বিএনপি- প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকেই জোটের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদের একজন সদস্য প্রিয়.কমকে বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আমাদের কিছু দাবি আছে। মেয়র পদে জোটের একক প্রার্থী সেটেলড্‌ হয়ে গেছে। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে চলমান মতবিরোধ সমাধানের উদাহরণ হচ্ছে ২০ দলীয় জোট নেত্রী, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জেলখানায় গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা আ.ন.ম. শামসুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান।’

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফশিল অনুযায়ী আগামী ১৫ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

প্রিয়