গল্পটি এমন একজন ব্রিটিশ দার্শনিকের যিনি প্রায় পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন খাটি নাস্তিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। অবশেষে এই মহাবিশ্ব ও প্রাণের পিছনে বুদ্ধিভিত্তিক সুসজ্জিত পরিকল্পনা দেখে নিজেও বিশ্বাস করেন, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বলে কেউ আছেন।
এন্থনি ফ্লিও, যে কিনা মাত্র ১৫ বছর বয়সেই একজন নাস্তিকে পরিণত হয়েছিলেন, তিনি এ নিয়ে ১৯৫০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কেও অংশ নিয়েছেন। নাস্তিকতার প্রচারকে তিনি সম্মানজনক কাজ বলেও বিশ্বাস করতেন, এমনকি ১৯৮৪ সালে এ নিয়ে তিনি “The Presumption of Atheism” বিখ্যাত বই ও রচনা করেছিলেন।
উনার গবেষণা ছিল খুবই সাধারণ। অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে আল্লাহ আছেন, এক্ষেত্রে নাস্তিকরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে আল্লাহ নেই। ফ্লিও বিষয়টিকে পাল্টে দিলেন। তিনি দাবী করলেন আল্লাহর অস্তিত্বের কোন প্রমাণ নেই। এখন ধর্মে বিশ্বাসীদের দায়িত্ব এটা প্রমাণ করা যে, আল্লাহ আছেন।
সময়ের সাথে সাথে ফ্লিও একজন খ্যাতিমান নাস্তিকে পরিণত হলেন। আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তিনি অন্যান্য কাজের পাশাপাশি প্রায় দশটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। তার কাজগুলো এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে সমগ্র দর্শন জগতে তা পুনঃমুদ্রিত হতে থাকে। অন্যান্য নাস্তিকদের মত তিনিও আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার হয়েছে কি না তা না জেনেই নাস্তিক হয়েছেন।
তাহলে কেনইবা ৮১ বছর বয়সে তিনি বিশ্বাসে পরিবর্তন আনতে গেলেন? প্রকৃতপক্ষে সারা জীবন নাস্তিকতা প্রচারের ফলে পরকালের শাস্তির ভয়ে তিনি এ কাজ করেন নি। এমনকি এখনো তিনি জান্নাত জাহান্নামে বিশ্বাস করেন না।তিনি মূলত আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তিনি আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে বিদ্যমান ডিএনএ গুলোর তথ্য সম্ভার দেখে বিস্মিত হয়েছেন। তিনি বলেনঃ
“আমি মনে করি ডিএনএ তে বিদ্যমান এই বহুমাত্রিক মৌলিক উপাদানকে একটি সুবিন্যস্ত পরিসরে সাজানোর পিছনে অবশ্যই একজন বুদ্ধিমান সত্ত্বার অস্তিত্ব রয়েছে। এ বহুমাত্রিক জটিল বিন্যাস আমাকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে যে, অবশ্যই তা এক বুদ্ধিমান সত্ত্বার কাজ।”
ফ্লিও লক্ষ্য করে দেখলেন, বহুসংখ্যক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বিশ্বাস করেন যে, এই মহাবিশ্ব ও জীবন গঠনের পিছনে বৈজ্ঞানিকভাবেই জ্ঞানগত কৌশল বিদ্যমান রয়েছে, একেই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন বা বুদ্ধিদীপ্ত নকশা বলা হয়ে থাকে। ২০০০ সাল থেকে তিনি এই ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করতে থাকেন। ২০০৩ সাল থেকে অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে এ নিয়ে তিনি আলোচনা শুরু করেন।
ডারউইনিজম নাকি ডিজাইন?
বুদ্ধিমান সত্ত্বা তত্ত্বের বিপরীতে অবস্থান করছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বা ডারউইনিজম। ডারউইনজমের মতে, নানাবিধ প্রাকৃতিক আকস্মিক পরিবর্তনের ফলেই, ক্ষুদ্র অ্যামিবা থেকে আজকের মানুষের সৃষ্টি হয়েছে যে কাজের জন্য কোন আল্লাহর প্রয়োজন ছিলনা।
এ বিষয়েই ফ্লিও অক্সফোর্ডের খ্যাতিমান নাস্তিক বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্সের কাছে ব্যাখ্যা দাবী করলেন। ডকিন্স শুধুমাত্র ডারউইনিজমের একনিষ্ঠ সমর্থকই ছিলেন না বরং ডারউইনিজমের আলোকে নাস্তিকতাবাদ প্রচারের অন্যতম কাণ্ডারী ছিলেন।
এ বিষয়ে ফ্লিও নিজেই বলেছেন, একজন ডারউইনিজম বিরবর্তনবাদের বিশেষজ্ঞ হয়েও এই ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে উঠা প্রশ্নের কোন সমাধান তিনি দিতে পারেন নি। সবশেষে ২০০৪ সালে আমেরিকান দার্শনিক গ্রে হাবেরমাসের কাছে আল্লাহর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নেন। একই বছরে ফিলোসোফিয়া ক্রিস্টি নামক দর্শন জার্নালে এ নিয়ে উনার প্রবন্ধ ছাপা হলে প্রকাশ্যে উনার মানসিক পরিবর্তনের কথা জানা যায়।
ফ্লিও অবশ্য স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, কোন দিক দিয়েই তিনি কোন ধর্মের অনুসারী হিসেবে এ বিশ্বাস স্থাপন করেন নি। আল্লাহ সম্বন্ধে তার বক্তব্য
“আমার কাছে মনে হয় তিনি এমন একজন ব্যক্তি যার কাজের যথাযথ জ্ঞান ও উদ্দেশ্য রয়েছে।”
বাস্তবিকভাবেই তিনি এখন বিশ্বাস করেন এই মহাবিশ্ব আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন।
তারপরও তার এ স্বীকৃতিকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এর মানে হচ্ছে ফ্লিও, আপনি কিংবা আমি সবারই আলাদা আলাদা লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে যা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তনশীল অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত। আজ আমরা এখানে তার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালা চেয়েছেন তাই। জীবনের জটিল পথে এ বিষয়গুলোই আমাদের মাঝে পার্থক্য গড়ে দেয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে ড. হারুন ইয়াহিয়া অনবদ্য অনেক বই রচনা করেছেন। আল্লাহই যে সকল সৃষ্টির স্রষ্টা তা বিভিন্ন বইয়েই সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন, উনার বিখ্যাত বইগুলোর মাঝে Evolution Deceit (Istanbul: Arastirma, 2002) এবং Signs of God: Design in Nature (Istanbul: Global Publishing, 2001) ছিল অন্যতম। কর্মের মাঝে ইয়াহিয়া এ বার্তাই আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, জীবনের উৎসের অনুসন্ধান কয়েক শতক আগের তুলনায় বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে অনেক সহজ হয়েছে। আমরা যত বেশি জানতে পারব ততই নাস্তিকতার দম্ভ খর্ব হতে থাকবে।
নাস্তিকতা মানেই “অকৃতজ্ঞতা ও অজ্ঞতা”
আপনার কি নাস্তিক হওয়ার মত যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আছে? এই সৃষ্টিজগতের অপার বিস্ময়কর সুসজ্জিত বিষয়গুলোকে আপনি বলবেন এমনি এমনিই হয়ে গেছে? যদি আপনি তা বিশ্বাস করেই থাকেন তবে আপনি হচ্ছেন একগুঁয়ে, এবং সংখ্যালঘুদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী নাস্তিকতাকে অস্বীকার করা হচ্ছে।
ইউরোপীয়ান সমাজবিজ্ঞানি পল এম. জুলেহনের মনে করেন,
“ইউরোপে প্রকৃত নাস্তিকদের সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়ে এমন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে যে, তাদের নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানে আর গবেষণা করার উপায় নেই।”
তাছাড়া ইউরোপিয়ানরা বরাবরই ধর্মবিমুখই থেকেছে। ফ্লিওয়ের এই যে পরিবর্তন হল, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রমাণসমূহই এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে এবং এ কারণেই দিন দিন নাস্তিকতা দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে।
তিনি আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন যে, বিংশ শতাব্দীতে মানুষ দলে দলে নাস্তিক হওয়ার কারণ ছিল মূলত মানুষ ধর্মের নামে সংঘটিত অন্যায়গুলো থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রগুলো যেমন সমাজতন্ত্রবাদী ও নাৎসি তেমন তারা নিজেরা প্রত্যেকেই ছিল ধর্মের অনুসারী। আর সর্বক্ষেত্রে অন্যায়কে নতুন মাত্রায় ছড়িয়ে দিয়েছিল।
হারুন ইয়াহিয়া ইউনাইটেট প্রেস ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
“শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষ বিজ্ঞান ও উপযোগীতার নামে যেভাবে নাস্তিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে তার অর্থই হচ্ছে তারা “সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং অকৃতজ্ঞ”।
যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হয় তবে যেখানে “একটি কোষের মাঝে এন্সাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার সমপরিমাণ তথ্য রাখা যায়” তার পিছনে কোন বুদ্ধিমান সত্ত্বার অনুপস্থিতির কথা বলার চাইতে নির্বুদ্ধিতা আর নাই। (Insight on the News, March 14, 2005)
ইয়াহিয়া তার Evolution Deceit বইয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন,..
একুশ শতক হয়ে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত যখন মানুষ স্বর্গীয় বিষয়গুলো বুঝতে পারবে এবং দলে দলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার দিকে ফিরে আসবে। (পৃষ্ঠা. ২৪৮)
islamibarta