ভারতের পশ্চিমবঙ্গকে নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত করে ও প্রস্তুতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। এই বিরাট পরিকল্পনা প্রকাশ হওয়ার পর তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশের প্রশাসন।
বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের তদন্তে করতে গিয়ে ভারতের গোয়েন্দারা এ তথ্যের সন্ধান পান। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে ৫৮টি জঙ্গি ঘাঁটিসহ আরো কিছু বিষয় উঠে এসেছে বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ের বোমা বিস্ফোরণের তদন্তে। এই তদন্তের তদারকি করতে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে সোমবার দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাচ্ছেন। ভারতীয় গণামাধ্যমের প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন বাংলাদেশে পাঠানো হবে বলে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা মিডিয়াকে জানিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা জানান, ‘তদন্তে প্রতিদিনই আমরা নতুন তথ্য পাচ্ছি। আমাদের মনে হচ্ছে, এ বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে যোগ করা উচিত। কেননা এসব বিষয় আমাদের মতো বাংলাদেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে কিছুটা সময় লাগছে।’
গত ২ অক্টোবর বর্ধমানে বিস্ফোরণের ঘটনার পর ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) অনুসন্ধানে পশ্চিমবঙ্গে ৫৮টি জঙ্গি ঘাঁটির সন্ধান পাওয়ার তথ্যও ওই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানানো হবে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইএ এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সরবরাহ করা তথ্যের ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আজ কলকাতায় আসছেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডসের প্রধান জেএন চৌধুরী ও ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর প্রধান সৈয়দ আসিফ ইব্রাহিম। দোভাল খুব সম্ভবত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি ব্যক্তিগত চিঠি মমতা ব্যানার্জীর হাতে তুলে দেবেন। বর্ধমান বিস্ফোরণের তদন্তে আরো সমন্বয়ের বিষয়েও তারা কথা বলবেন বলে জানা গেছে।
মমতার তৃণমূল সরকার শুরুতে এ ঘটনায় এনআইএ’র তদন্তের বিরোধিতা করে বলেছিল, ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী আইন-শৃঙ্খলার বিষয়টি রাজ্য সরকারেরই দেখার কথা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার দাবি, ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন ও কাশ্মিরের জঙ্গিদের সঙ্গে মিলে পশ্চিমবঙ্গে এসব জঙ্গি ঘাঁটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র ইন্ধন স্পষ্ট। জেএমবি ও পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন আল-মুজাহিদীনের নেতাদের মধ্যে অসংখ্য ফোনকল আদান-প্রদান হয়েছে। আল-মুজাহিদীন আল-কায়েদার সহযোগী হলেও আইএসআই তাদের গোপনে মদদ দিচ্ছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ সূত্রগুলো বিবিসিকে জানিয়েছে, ভারতের মাটিকে যে বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না, বর্ধমানের ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় দ্রুত সেই বার্তাই পৌঁছে দিতে চাইছেন।
বিবিসি বাংলা বলছে, ভারতের জন্য এটিই সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয়, বর্ধমান বিস্ফোরণের পর এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বাংলাদেশ থেকে আসা বেশকিছু জঙ্গি ভারতের মাটিকে বাংলাদেশ-বিরোধী কাজের জন্য ব্যবহার করছে। নিউ ইয়র্কে গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম বৈঠকেও দু’জনে পরস্পরকে কথা দিয়েছিলেন, এক দেশের ভূখণ্ডকে কিছুতেই অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। তারপর সপ্তাহ না ঘুরতেই বর্ধমানের বোমাকাণ্ড উদ্ঘাটিত হল, যার সংস্পর্শ জেএমবি পর্যন্ত রয়েছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দারা বলছেন।
বাংলাদেশ সরকার কিন্তু গত প্রায় ছয় বছর ধরে ভারতীয় জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালিয়ে আসছে, অনেককে ভারতের হাতে তুলেও দেয়া হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র বিবিসিকে বলেছেন, দোভালকে যে বর্ধমান তদন্তের সার্বিক তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারও বড় কারণ এটা বাংলাদেশকে এই বার্তাটা দেয়া যে, ভারত কিছুতেই তাদের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো কার্যকলাপ বরদাশত করবে না!
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে একটি বাড়িতে গত ২ অক্টোবর বোমা বানাতে গিয়ে শাকিল আহমেদ ও সুবহান মণ্ডল নামে দু’জন নিহত হয়। তারা বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য বলে দাবি করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। ঘটনার পর গ্রেফতার শাকিল আহমেদের স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও আহত আবদুল হাকিমের স্ত্রী আলিমা বিবিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই দু’জন বলেছে, তারা জেএমবির সঙ্গে যুক্ত। এরপর এ ঘটনায় একের পর এক তথ্য বের হতে থাকে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন ঢাকাও। এ বিষয়ে ভারতের কাছে তথ্য চেয়েছে বাংলাদেশ।
জঙ্গি ইউসুফের খোঁজ পেয়েছে এনআইএ?
এদিকে বর্ধমান বিস্ফোরণকাণ্ডের ২৪ দিন পর শিমুলিয়ার জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রধান ইউসুফের খোঁজ পেয়েছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ (এনআইএ)। জঙ্গি তৎপরতায় অভিযুক্ত ইউসুফ বর্তমানে উত্তরবঙ্গের কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে বলেও ধারণা করছে এনআইএ। তাদের সন্দেহ, উত্তরবঙ্গ থেকে আসাম বা নেপালে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গি ইউসুফ। সে কারনে তাকে ধরার জন্য ওইসব এলাকায় গোয়েন্দা জাল পেতেছে এনআইএ।
জানা যায়, বর্ধমান বিস্ফোরণে জঙ্গি তৎপরতার অন্যতম এই মূলহোতার খোঁজ করতে গিয়ে দুদিন আগেও উত্তরবঙ্গে তার উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারীরা। তার মোবাইল ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে এন আই এ জানতে পেরেছে, গত ২ অক্টোবর খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরেরদিন বিকেল পর্যন্ত স্ত্রী তিন সন্তানকে নিয়ে বর্ধমানেই ছিল ইউসুফ। সন্ধ্যায় সেখান থেকে সে যায় বীরভূমের কীর্ণাহারে।
সেখান থেকে এক সহযোগীর মাধ্যমে গাড়ি ভাড়া করে ইউসুফ যায় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় পলাতক জঙ্গি লাদেন তাকে আশ্রয় দেয় বলেও জানতে পারে এনআইএ। সেখান থেকে বাসে চেপে শিলিগুড়ির কোন এক ঘাঁটিতে পৌঁছে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখে বর্ধমানকাণ্ডের এই মুলচক্রী।
গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পারে, উত্তরবঙ্গের নেপাল সীমান্তের কোন এক ঘাঁটিতে গা ঢাকা দিয়েছে ইউসুফ।
তারা আরো জানতে পেরেছে, ইউসুফের সঙ্গে বাংলাদেশি জঙ্গিনেতাদের এখনো যোগাযোগ রয়েছে। তাকে ধরা গেলে অন্যদের খোঁজও পাওয়া যাবে বলে আশা করছে গোয়েন্দারা। তবে বাংলাদেশে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকায় ইউসুফ সে পথে যাবে না বলেই মনে করছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ।
The Bangladesh Today