এখনো অগোছালো ঢাকা মহানগর বিএনপি

ঢাকা মহানগর বিএনপি এখনো অগোছালো। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হলেও উত্তর-দক্ষিণের আংশিক কমিটি পার করেছে বছর। মাঠে সাংগঠনিক শক্তিমত্তাও ফুটে উঠেনি। বছরজুড়ে কেন্দ্রঘোষিত থানায় থানায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে ঝটিকা মিছিলের মধ্য দিয়ে। আংশিক কমিটিতে পদ পাওয়া অনেক নেতা মাঠে ছিলেন নিষ্ক্রিয়। মহানগরের শীর্ষ নেতারাও দলীয় ফোরামে একত্রে বসে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া তৈরি করতে পারেননি।

যদিও উত্তর ও দক্ষিণের শীর্ষ নেতারা দাবি করেছেন, ঢাকা মহানগর বিএনপি এখন অনেক শক্তিশালী। জেল-জুলুম-নিপীড়ন উপেক্ষা করে প্রতিটি কর্মসূচিতে তারা মাঠে ছিলেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামে তারা মাঠে থাকতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

পুরনো কমিটির সাংগঠনিক ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে গত বছরের ১৮ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ঢাকা মহানগরকে দুই ভাগ করে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। মহানগর উত্তরে দায়িত্ব পান এম এ কাইয়ুম ও আহসান উল্লাহ হাসান এবং দক্ষিণের নেতৃত্ব তুলে দেয়া হয় হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ও কাজী আবুল বাশারের হাতে। নতুন এই নেতৃত্ব ঘিরে বিএনপি হাইকমান্ডের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। সিনিয়র একাধিক নেতা বলেছেন, সভা-সমাবেশের অধিকার যেখানে নেই, সেখানে সাংগঠনিক শক্তিমত্তা দেখানো মুশকিল। তবে নির্বাচনের এ বছরটি ঢাকা মহানগর বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ। মাঠে থেকেই সব প্রতিকূলতার জবাব দিতে হবে।

এক বছর আগে কমিটি গঠনের পর নতুন নেতৃত্বের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল সংগঠন গোছানো। কিন্তু তা হয়নি। দক্ষিণের ৭০ সদস্যের আংশিক কমিটি এবং উত্তরে ৬৬ সদস্যের আংশিক কমিটির কোনোটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। যদিও তখন এক মাস সময় বেঁধে দিয়েছিল কেন্দ্র। যার ফলে আংশিক কমিটিতে পদ না পাওয়া নেতাদের মধ্যে হতাশা রয়েই গেছে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর কমিটি না হওয়ায় পদহীন নেতারা এখন কর্মসূচিবিমুখ। আবার পদ নিয়ে পগার পার অনেক নেতা। কোনো কোনো নেতাকর্মীদের দিয়ে কর্মসূচি পালন করিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও এসব নেতার শারীরিক উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। ফটোসেশন কিংবা সেলফিতে কর্মসূচি সফল হয়েছে বলে প্রচারণা চালানো হয়।

মহানগরের থানা কমিটিও পড়ে আছে অগোছালো অবস্থায়। রাজধানীর ৪৯টি থানার প্রায় অর্ধেকে কমিটি রয়েছে, যার বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর। যদিও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করার কথা রয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ১৯৯৯ সালে গঠন করা হয় খিলগাঁও ও সবুজবাগ থানা কমিটি, ১৯৯৭ সালে গঠন হয় মতিঝিল ও কোতোয়ালি থানা কমিটি, ২০০৬ সালে গঠিত হয় ডেমরা থানা কমিটি, কামরাঙ্গীরচর থানা কমিটি হয় ২০০০ সালে, ২০০৪ সালে হয় ক্যান্টনমেন্ট থানা কমিটি, ২০০১ সালে বাড্ডা ও গুলশান থানা কমিটি গঠন করা হয়। গুলশান থানা কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন (বীর প্রতীক) ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ায় ১১ বছর ধরে সভাপতির পদ শূন্য রয়েছে গুলশান থানায়।

পল্লবী থানা কমিটি হয় ২০০৫ সালে। এখলাস উদ্দিন মোল্লা ছিলেন ওই কমিটির সভাপতি, পরে ২০০৬ সালে তিনিও আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। সভাপতির পদ এ থানায়ও শূন্য রয়েছে।

১৯৯২ সালে এহসানুল হক সেতুকে সভাপতি ও এস এম গোলাম কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় মোহাম্মদপুর থানা কমিটি। এরপর ১৯৯৮ সালে আফজালুল হককে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয় মহানগর শাখা। এ থানায় শুক্রাবাদের সাবেক কমিশনার আব্দুল লতিফকে প্রধান সমন্বয়কারী করে ২০১২ সালে একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে, যা এখন কার্যকর নেই। ১৯৯৮ সালে তেজগাঁও থানা কমিটি হয়। মিরপুর থানা কমিটি হয় ২০০৫ সালে সৈয়দ বদরুল আলম বাবুলকে সভাপতি করে। জানা যায়, বদরুল আলম বাবুল দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

কেবল থানাগুলোই নয়, মহানগরের ওয়ার্ডগুলোর অবস্থা আরো করুণ। প্রশাসনিক ৯০টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগের হালনাগাদ কোনো কমিটি নেই। এমনো ওয়ার্ড রয়েছে, যা ২৫ বছর ধরে অভিভাবক শূন্য।

দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল গ্রেফতার এড়িয়ে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। আর খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের কর্মসূচি থেকে মাসখানেক আগে গ্রেফতার হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার। কমিটির এক বছর পূর্তিতে সাংগঠনিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক তানভীর আহমেদ রবিন নয়া দিগন্তকে বলেন, দক্ষিণ বিএনপি সাংগঠনিকভাবে যে শক্তিশালী তা সাম্প্রতি আন্দোলন কর্মসূচিতে প্রমাণ পাওয়া যায়।

এই কমিটির নেতারাও আন্দোলনের মাঠ থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। কেউ ঘরে বসে ছিলেন না। আমি নিজেও গ্রেফতার হয়ে তিন মাসেরও বেশি সময় কারাগারে ছিলাম, সভাপতি কারাগারে ছিলেন, সাধারণ সম্পাদক এখন করাগারে। আর দীর্ঘ সময় নেতারা কারাগারে থাকায় বেঁধে দেয়া সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা সম্ভব হয়নি। রবিন জানান, দক্ষিণে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। দেশনেত্রী মুক্তি পেলেই তা ঘোষণা করা হবে ।


উত্তরের সভাপতি এম এ কাইয়ুম মামলার কারণে দেশে আসতে পারছেন না শুরু থেকেই। গত এক বছরের কার্যক্রম প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান বলেন, বিগত সময়ে বছরের পর বছর কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। এমন সময় দায়িত্ব পেয়ে ওয়ার্ড, থানা কমিটি গঠন করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে একটু সময় লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। এরপরেও পুরো কমিটি গঠন করে রাখা হয়েছে। কিন্তু চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে তা ঘোষণা দেয়া যাচ্ছে না।

এক বছরের কার্যক্রম ও সফলতার বিষয়ে হাসান বলেন, বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা মহানগর কমিটি এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। প্রতিটি কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। হাইকমান্ডও বর্তমান কমিটির কার্যক্রমে সন্তুষ্ট। সফলতার উদাহরণ দিতে গিয়ে হাসান বলেন, খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার দিনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মীরা যেভাবে তাকে আদালতে নিয়ে যান তাতে প্রমাণ হয়েছে বর্তমান কমিটি কতটা শক্তিশালী।

Naya Diganta