কোটা বিরোধী আন্দোলনের সেই চার নেতার একজন মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সক্রিয় কর্মী। আন্দোলনকে সহিংসতায় রূপ দেওয়া এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনে নারকীয় তান্ডবে এই রাশেদ খান জড়িত। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সংস্থার নেটওয়ার্কে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে এসেছে। ‘ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশকারী শিবির-ছাত্রদল, ভিসির বাড়িতে হামলায় জড়িত’ প্রধান শিরোনামে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদের পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধানে নামে। দৈনিক ইত্তেফাকও অনুসন্ধান শুরু করে।
ফেইসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনের একাউন্টে শিবিরের সমর্থক হওয়ার বিভিন্ন প্রমাণ মিলেছে। নিজের ফেইসবুক একাউন্টের একটি পাতায় মুহাম্মদ রাশেদ খান লিখেছেন, ‘কোটা বিরোধী আন্দোলনের মুখপাত্রের নামের তালিকা; কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আইয়ূবী, কেন্দ্রীয় ছাত্রশিবিরের স্কুল কার্যক্রম বিষয়ক সম্পাদক মাশরুর হোসাইন, কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের প্রকাশনা সম্পাদক সালাউদ্দিন মাহমুদ, কেন্দ্রীয় ছাত্রশিবিরের বিতর্ক বিভাগের সভাপতি আল মামুন রাসেল।’ ফেইসবুকের আরেকটি পাতায় মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন লিখেছেন, ‘একমাত্র ইসলামের ছায়াতলে রয়েছে শান্তি ঠিকানা।’ এই শিরোনামের নিচে রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের বিকৃত করা ৫টি ছবি। এছাড়া শিবিরের পাতা বাঁশের কেল্লার একাধিক লেখায় লাইক দেয় এই মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোটা বিরোধী আন্দোলনকে চরম সহিংসতায় রূপ দিতে তত্পর ছিল জামায়াত-শিবির ও বিএনপির একশ্রেণীর নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে শিবিরের তত্পরতা ছিল বেশি। তারা দেশজুড়ে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করেছিল। কোটা বিরোধী আন্দোলনের চার নেতার বিষয় সম্পর্কে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধান শুরু করে। সেই চার নেতার একজন হলেন মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন। তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক। তার গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায় সদর উপজেলার মুরারীদহ গ্রাম। তার বাবার নাম সবাই বিশ্বাস। তিনি একজন রাজমিস্ত্রি। মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন বাবার একমাত্র পুত্র সন্তান, তার দুই বোন রয়েছে। মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন সূর্যসেন হলের আবাসিক ছাত্র।
তবে সে হলে থাকতো না। ২০১২ সালে সূর্যসেন হলের ৫০৫ নম্বর কক্ষে থাকতো। শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় এবং শিবিরের লেখা বাঁশের কেল্লায় লাইক দেওয়ায় সে হলে থাকতে পারতো না। নিজের গ্রামের বাড়িতেও তার যাতায়াত ছিল না। তবে ঢাকার একজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে নাশকতায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল বেশি। ইত্তেফাকের অনুসন্ধানে চার নেতার সার্বিক বিষয় পাওয়া গেছে। এছাড়া তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও চার নেতার তথ্য উদঘাটন করছে। ইতিমধ্যে মুহাম্মদ রাশেদ খাঁনের শিবিরে সংশ্লিষ্ট থাকার তথ্যটিও তারা পেয়েছে।
এদিকে কোটা বিরোধী আন্দোলনের অন্য তিন নেতার তথ্যও ইত্তেফাকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। নেত্রকোনার সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নন্দীপুর গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে হাসান আল মামুন। তিনি কোটা বিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক। বর্তমানে তিনি ছাত্রলীগের ঢাবির মহসিন হল শাখার সহ-সভাপতি। তার পুরো পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বাঁশের কেল্লায় অনেক লেখায় তার লাইক দেওয়া আছে। নেত্রকোনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ফয়জুর রহমান খান উমি বলেন, সে শিবিরের কর্মকান্ডে জড়িত। গোয়েন্দা সংস্থা তার ব্যাপারে তথ্য অনুসন্ধান করছে।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন। তার বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদরে। বালিয়াডাঙ্গি সমীর উদ্দিন কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে ছাত্রলীগে যোগ দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা জানে সে শিবিরের কর্মকান্ডে জড়িত। এ কারণে সে ছাত্রলীগের যোগদান করতে পারেনি। এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এসএম হলের তত্কালীন ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হয়। তার ঘনিস্ট বন্ধু বলেন, এখানে এসে শিবিরে যোগ দেয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের কর্মকান্ড না থাকায় পরে কৌশলে ছাত্রলীগে যোগ দেয়। কিন্তু আদর্শ বহন করে শিবিরের।
কোটা বিরোধী আন্দোলনের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর। তার বাড়ি পটুয়াখালীর কলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নে। তার বাবার নাম ইদ্রিস হাওলাদার। সাবেক ইউপি সদস্য। তিনি এক সময় বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিল। এখন কোন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না। তার বাবা দুই বিয়ে করে। নুর প্রথম ঘরের সন্তান। স্থানীয় জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে নুর সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। এরপর গাজীপুরে তার বোনের বাসায় থেকে পড়ালেখা করে। তার শশুর হাতেম মাস্টার জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। গাজীপুরে এইচএসসি পাস করে সে ঢাবিতে ভর্তি হয়। চরবিশ্বাস ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হলেন হাতেম মাস্টার। নুর হলো ঢাবির মহসিন হলের সাবেক উপ-মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক। তার স্ত্রী সরকারি কবি নজরুল ইসলাম কলেজের অনার্সে ছাত্রী।
চার নেতার বক্তব্য
শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসান আল মামুন বলেন, আমার বাবা ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের একটি ইউনিটের সভাপতি ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন কিন্তু সনদ নেননি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক সেটি ভালোভাবেই জানেন। শিবির সংশ্লিষ কোনো পেজে লাইক বা কমেন্টস নেই বলে দাবি করে তিনি বলেন, আমি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ছাত্রলীগের চলতি কমিটির সহ-সভাপতি।
আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নুর বলেন, ২০০৬ সালের চর বিশ্বাস জনতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাত্রলীগ কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। ২০১৩ সালে সেপ্টেম্বর থেকে ঢাবি মুহসীন হল ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ছিলাম। আমার বাবা ২০০৯ থেকে ১৪ পর্যন্ত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি বর্তমান চর বিশ্বাস ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি।
যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হাসান বলেন, তিনি ঢাবি এসএম হল ছাত্রলীগের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন।
যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, আমি একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না । ফেইক আইডির মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।
ittefak