কোটা বাতিলের ঘোষণার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত হওয়ায় আওয়ামী লীগে আপাত স্বস্তি বিরাজ করছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরে গেলেও কোটা বহালের পক্ষে পাল্টা একটি গ্রুপ রাজপথে নামার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেরি হলে যেকোনো সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবারো আন্দোলনে নামতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র আভাস দিয়েছে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখেই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। কারণ, এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনে অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আন্দোলন স্থগিত হওয়ায় আর সেটা থাকছে না। এ ছাড়া নির্বাচনের বছরে এ আন্দোলন আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ দিলে তা পর্যায়ক্রমে সরকারবিরোধী বা সরকারপতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলে মনে করেছিল ক্ষমতাসীনেরা।
সরকারবিরোধী জোটও এ আন্দোলনের সুযোগ নিতে পারে বলে ধারণা করা হয়; কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। আর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেয়ায় আগামী নির্বাচনে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। দাবি মেনে নেয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব এডুকেশন’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন; যা প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ আরো উজ্জ্বল করেছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বেশ স্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীনেরা।অন্য দিকে আন্দোলনের মুখে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবি মেনে নেয়ায় চরম ুব্ধ কোটার সুবিধাভোগীরা।
সরকারি চাকরিতে কোনো ধরনের কোটাই থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা মেনে নিতে পারছে না তারা। ফলে পাল্টা একটা গ্রুপ নতুন করে রাজপথে নামতে পারে। ইতোমধ্যেই কোটার পক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানসহ বিভিন্ন সংগঠন।
কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি হলে তাদের আন্দোলন আরো জোরদার হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে; যা সরকারের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি করতে পারে। অন্য দিকে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করতে দেরি হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আবারো শুরু হতে পারে বলে বিভিন্ন মহল থেকে আভাস দেয়া হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে খানিকটা চিন্তিত রয়েছেন সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা।বিভিন্ন সরকারি সূত্র জানায়, কোটা প্রথাকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এতটা গতি পাবে তা ধারণাও করতে পারেননি সরকারের নীতি নির্ধারকেরা।
সরকারের কোনো গোয়েন্দা সংস্থাও এমন তথ্য দিতে পারেনি। সেজন্য শুরুর দিকে এ আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব দিতে চায়নি সরকার। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটাব্যবস্থা বহাল থাকবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এ আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে টনকনড়ে সরকারের।
বিশেষ করে পুলিশের সাথে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষের পরও আন্দোলন না থামলে চিন্তায় পড়েন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। একই সাথে নির্বাচনের বছরে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হয়; যা সামাল দিতে চরম হিমশিম খেতে হতো সরকারকে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সেই আশঙ্কা উবে গেছে।
মতাসীন দলের তিন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘সরকারপ্রধানের আশ্বাসের পরেও এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া মানেই হলো চক্রান্তকারী বিশেষ মহল ঢুকে পড়েছে শিার্থীদের আন্দোলনে। তাই ইস্যুটি নিয়ে বেশি দূর যাওয়ার সুযোগ কাউকে দিলেই সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হতো। ফলে কাউকে সুযোগ না দিতেই সব কোটা বাতিলের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে সরকারপ্রধানকে। আর আন্দোলন নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে এমন স্বপ্নে যারা বিভোর ছিল, তাদের রণে ভঙ্গ হলো প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণায়।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় তরুণ প্রজন্ম আগামী নির্বাচনে নৌকার পক্ষেই থাকবে বলে ধারণা তাদের। কারণ, তারা চেয়েছিল পেইন কিলার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন ‘এন্টিবায়োটিক’। আশা করি এসব শিক্ষার্থী আমাদের সাথেই থাকবে; যা অত্যন্ত আনন্দের খবর।তবে তাদের মধ্যে দুইজন নেতা নতুন আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, সব কোটা বাতিল করায় খানিকটা সমস্যাও রয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক কিছু করছে; কিন্তু সব কোটা বাতিল হওয়ায় তারা নাখোশ হবেন।
শুধু তাই নয়, কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনকারীরা ঘরে ফিরে গেলেও কোটা বহাল চেয়ে নতুন করে আরেকটি পক্ষ আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের আন্দোলনের খবর পাচ্ছি; যা সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তির বিষয়। প্রজ্ঞাপন জারি হলে তাদের অবস্থান কী হয় তা নিয়ে সরকারে উদ্বেগ রয়েছে।’
এ দিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে গতি দেয়ার জন্য দলের বিভিন্ন ফোরামে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কঠোর সমালোচনা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তাদের মতে, সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক এবং কোটাব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আশ্বাসের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন খানিকটা থমকে গেলেও তাতে নতুন করে ‘ঘি ঢালেন’ কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী।
তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ সম্বোধন করে জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিলে সরকারের আশ্বাস নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে। নতুন করে ক্ষোভে ফুঁসে উঠে শিক্ষার্থীরা। ফলে মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের পর আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। সারা দেশ প্রায় অচল হয়ে পড়লে সরকারও কোটা নিয়ে ত্বরিত সিদ্ধান্তের দিকে যায়। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো কোটাব্যবস্থাই থাকবে না বলে জাতীয় সংসদে সাফ জানিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাসে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। ফলে আমাদেরকে কথাবার্তায় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কারো বক্তব্য যেন সরকারের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে না যায়।’দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘কোটা সংস্কারের বিষয়টি দেখা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিার্থীদের আশ্বস্ত করেছেন; কিন্তু আন্দোলনকারী শিার্থীরা কোটা সংস্কারের আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে সব কোটা বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণা দেয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল বলে আমরা মনে করি না।’দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এখন কোটা নেই, আর আন্দোলনও থাকার কথা নয়। আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর হাতে আর কোনো অপশন না থাকায় তিনি সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়ে উত্তম কাজটিই করেছেন। আসলে প্রধানমন্ত্রী যে একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক তার এমন ঘোষণার মাধ্যমে সেটি আবারো প্রমাণ হয়েছে।’
dailynayadiganta