দুদক : বিএনপি নেতাদের জন্য নতুন ফাঁদ

বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে তৎপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো চাঙ্গা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ আট নেতার বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ ছাড়া গত মাসে বিএনপির সাবেক দুই এমপি আসাদুল হাবিব দুলু ও রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।

দুই কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। তার জামিন স্থগিতে ও সাজা বাড়াতে দুদকের আইনজীবী খুবই তৎপর। এ ছাড়াও বিএনপির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ও অনুসন্ধান চলমান। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিএনপির প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেবেন দুদকের কর্মকর্তারা। এরপর অনুমোদন পেলে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ খান সিদ্দিকী, বিএনপির সহসভাপতি ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক।

বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা এগিয়ে নিলেও দুদকের অনেক মামলায় দায়মুক্তি পাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতারা। গত ২৫ জানুয়ারি গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে ওয়ান-ইলেভেনের সময় দায়ের করা একটি দুর্নীতি মামলা থেকে খালাস দেন নিম্ন আদালত। এখনো এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেনি দুদক।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর মামলার বিচারিক কাজ আদালতে চলমান আছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যদের হলফনামায় সম্পদের তথ্য জালিয়াতি নিয়ে প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক, আবদুল মান্নান খান, মাহবুবুর রহমান, আসলামুল হক, এনামুল হক, আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুদক। এদের মধ্যে হলফনামায় তথ্য দিতে ‘ভুল হয়েছে’ এ যুক্তি গ্রহণ করে আ ফ ম রুহুল হক ও আসলামুল হককে অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দেয় দুদক। এরও আগে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেন ও বিটিএমসির সাবেক চেয়্যারম্যান আবুল কালাম।

২০১২ সালে বহুল আলোচিত রেলের কেলেঙ্কারির ঘটনায় মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানই চালায়নি দুদক। আর টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয়ার েেত্র অর্থ লেনদেনের অভিযোগ বিষয়ে তার ছেলে সৌমেন সেনগুপ্তকেও দায়মুক্তি দেয়।

এ ছাড়াও দায়মুক্তি দেয়া হয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীকে।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দকৃত গম আত্মসাতের অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভাইয়ের ছেলে ও রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য হোসেন মকবুল শাহরিয়ার। রেলের নিয়োগ-বাণিজ্যে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক ইউসুফ আলী মৃধাকে পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়্যারম্যান কাজী বাহারুল ইসলাম ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী। হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই আনেনি দুদক।


দুদকের দায়মুক্তি পান কক্সবাজার-২ আসনের আলোচিত-সমালোচিত এমপি আবদুর রহমান বদি। টেকনাফ পৌরসভার মেয়র থাকার সময় রাজস্ব ও উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগ থেকে তিনি দায়মুক্তি পেয়েছেন।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ শীর্ষস্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলাগুলোর কিছু উচ্চ আদালত থেকে বাতিল করে দেয়া হয়, কিছু মামলার ব্যাপারে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

কৃষিব্যাংকের ৩০২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের মামলায় জামিন পেয়েছেন মো: হজরত আলী।
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশনের এমন অবস্থানে প্রতিষ্ঠানটির স্বাধীন ভূমিকা পালন নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি করছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, অভিযোগ এলে তদন্ত করবে এ জন্য দুদক সাধুবাদ পেতে পারে। তবে তদন্তের স্বচ্ছতা থাকতে হবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো দল বা নেতাকর্মীদের হেয় করতে কোনো কাজ করা হচ্ছে জনমনে এমন প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়ায় কাম্য নয়। এ জন্য দুদকে সতর্কতার সাথে কাজ করতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অভিযোগের গুণগত মান ও স্বচ্ছ তদন্তই আমরা আশা করি। দুদককে এ তদন্তে নিরপেতার প্রমাণ দিতে হবে। স্বচ্ছ ও নিরপে তদন্তে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তার শাস্তি প্রাপ্য। কিন্তু আইন সবার জন্য সমান এবং দুদক সমতার নীতিতে আইন প্রয়োগ করছে, তা প্রমাণ করা জরুরি। বিএনপির এতজন নেতার বিরুদ্ধে একসাথে তদন্ত শুরু হওয়ায় স্বাভাকিভাবেই এ তদন্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। দুদককেই স্বচ্ছ ও নিরপে তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলা, রায়, জামিন ও সাজা বৃদ্ধির জন্য দুদকের আপিল ও অতি তৎপরতা থেকে প্রতীয়মান হয়, দুর্নীতি দমনে দুদকের ভূমিকা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি একটি দুর্যোগময় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।

এ সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলনিরপে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে তা দেশের সামগ্রিক সম্ভাবনাকে আরো দুরূহ করে তুলতে পারে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি নেতাকর্মীদের দুর্নীতি তদন্তের নামে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে তাতে দুদকের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। দুদক একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এটি কোনো একটি দলের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করুক, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

দুদক রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে মামলা বা তদন্ত করছে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, অভিযোগ এসেছে, তদন্ত হবে। তদন্ত শেষেই সব কিছু জানা যাবে। রাজনৈতিক নেতারা কে কী বলছে, এটা তাদের ব্যাপার। রাজনৈতিক ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই। নির্বাচনের বছর বলে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাছে নির্বাচন কোনো ইস্যু না। নির্বাচন যাদের কাছে ইস্যু, এ বিষয়টি তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন। আমাদের কাছে সব বছরই সমান বছর। সব দিনই সমান দিন।

সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ আট নেতাসহ ১০ জনের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। শীর্ষ আট নেতা হলেন- দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, নজরুল ইসলাম খান, সহসভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু, এম মোর্শেদ খান, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, নির্বাহী সদস্য তাবিথ আউয়াল, এম মোর্শেদ খানের ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খান ও ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে তারা ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে।

অভিযুক্ত বিএনপি নেতারা দুদকের তদন্তের বিষয়ে প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের কাছে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করতেই দুদককে কাজে লাগানো হচ্ছে। হঠাৎ করে বিএনপির সিনিয়র নেতা ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে বাধাদান এবং বিএনপিকে কালিমালিপ্ত করতেই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে।
Naya Diganta