বাংলাদেশের সাড়ে চার দশকের রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতনের সাক্ষী জয়নুল আবদিন ফারুক। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদান রাখা ফারুককে গত কয়েক দশকে এক পা-ও পেছন ফিরতে হয়নি। ক্রমে হয়ে উঠছেন বিএনপির অপরিহার্যদের একজন। একে একে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন প্রায় ২৬ বছর নোয়াখালী সেনবাগ উপজেলা বিএনপি সভাপতি পদে। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের অন্যতম এই সদস্য সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয়ে উঠেছেন নোয়াখালী বিএনপির অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি, আস্থার প্রতীক। সৎ, বিনয়ী এবং উদারপন্থী রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত জয়নুল আবদিন ফারুক সর্বশেষ যে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেন সেই নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপের।
সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন গণমাধ্যম ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি-এর মুখোমুখি হন এই রাজনীতিক। দীর্ঘ সময়ের কথোপকথনে উঠে আসে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলনে বিএনপির সফলতা ও ব্যর্থতা সহ-নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ব্রেকিংনিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট এস এম আতিক হাসান।
ব্রেকিংনিউজ: দেশের চলমান রাজনীতির গন্তব্য কি?
জয়নুল আবদিন ফারুক: দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে তখন দেখা যাবে প্রশাসন একসময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে শুরু করবে। দেশের চলমান রাজনীতিতেও আমরা যেভাবে জেলা ও বিভাগীয় সমাবেশ করছি। সমাবেশগুলো শেষ হলে সারা বাংলাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থার কেন্দ্রীয় নেতারা একটা রিপোর্ট তৈরি করবেন। তারপর শীর্ষনেতারা একটি সঠিক সিদ্ধান্তে যাবেন। এরই মধ্যে আমার বিশ্বাস আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসবেন। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিবেন। আর যদি বেগম খালেদা জিয়ার জামিন দীর্ঘায়িত হয় বা তারা (সরকার) তালবাহানা করেন তাহলে তো একটা ওই যে তৃণমূল নেতাদের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে সরকারকে একটা ধাক্কা দেয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ সেই শক্তি বিএনপির আছে। কিন্তু এখন হুজুগে কোন ধাক্কা দিয়ে শক্তি নষ্ট করার চেয়ে ধৈর্য ধারণ করাই ভাল।
ব্রেকিংনিউজ: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও আপনারা নির্বাচনে আসবেন কিনা?
জয়নুল আবদিন ফারুক: ২০১৪ সালের নির্বাচনে আমরা যে কারণে যাইনি সে কারণটি আবারও তারা (আওয়ামী লীগ) পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছে। তারা সংবিধান-সংবিধান বলছে। সংবিধান, এটা তো পরিবর্তনশীল। সংবিধান তো আল্লাহর কোরআন না যে এটা অমিট করতে পারবো না, ডিলিট করতে পারবো না।
সে কারণে তারা ২০১৪ সালে বিএনপির মতো বৃহত্তম রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন করেছিল; সেই নির্বাচন তারা গায়ের জোরে, পুলিশি সহযোগিতায় নিপীড়ন-নির্যাতন করে প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তবু বেগম খালেদা জিয়া দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেক কিছু সহ্য করেছেন। তাদের (সরকারি দল) অত্যাচার-অবিচারে আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করতে পারিনি। আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা-গুম করা হচ্ছে, হামলা-মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হচ্ছে। তবুও আমাদের চেয়ারপারসন সমঝোতার ডাক দিয়েছেন। এখনো সমঝোতার দ্বার খোলা আছে। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এজন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে একটি নিরপেক্ষ বা সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
আমরা মনে করি ২০১৪ সালের পুনরাবৃত্তি করে যদি আরেকটি নির্বাচন হয়, সে নির্বাচন দেশের মানুষ বা বিশ্বদরবারের কেউ মেনে নেবে না। গায়ের জোরে কতক্ষণ থাকা যায়? সবসময় থাকা যায় না। আমি মনে করি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত। যদি আওয়ামী লীগ সরকার মনে করে দেশে শান্তির আবহ বজায় থাকুক সেক্ষেত্রে জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের নেগোসিয়েশনে বসা। তাহলে একটা শান্তির পথ উন্মুক্ত হতে পারে- এটাই আমার বিশ্বাস।
ব্রেকিংনিউজ: একদিকে রাজনৈতিক সমঝোতা, অন্যদিকে আন্দোলনের হুমকি; নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান কি?
জয়নুল আবদিন ফারুক: আমি মনে করি আওয়ামী লীগ থেকে আমাদের শিখতে হবে না। আওয়ামী লীগকে আমাদের কাছ থেকে শিখতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগের হাতে স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে পার্লামেন্টকে। বাকশাল গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের পাকিস্তান আমলের বক্তৃতা আমাদের মনে আছে। তখন আমরা ছাত্রলীগ করতাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে আমরা আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। তখন আলোচনার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন সময় নষ্ট করা হয়েছে।
এ সুযোগে পাকিস্তান তার বর্বর সেনাবাহিনীকে এ দেশে আনার সুযোগ পায়। তখন ইয়াহিয়া খানকে সাফ বলে দেয়া যেত, আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। আজকের মধ্যে ক্ষমতা না দিলে তোমার সঙ্গে আসসালামু আলাইকুম। যেটা মাওলানা ভাসানী বলেছেন। তারা এটা বলতে পারত। কিন্তু না বলে তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। আমি মনে করি আওয়ামী লীগ তখন ভুল করেছিল কিন্তু তারা সেটা স্বীকার করে না।
আমি মনে করি আওয়ামী লীগ দুই টার্ম পার্লামেন্ট করেছে। তাদের আর দরকার নেই। তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে ‘গুড এক্সিট’ নিয়ে চলে যাক। আমি ক্ষমতায় যাব সেটা কথা নয়। একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনে সাম্যবাদী দল ক্ষমতায় আসলেও আমি তাদের সাপোর্ট করব।
ব্রেকিংনিউজ: আন্দোলনে বিএনপি কেন গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারছে না?
জয়নুল আবদিন ফারুক: আমরা গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পারি নাই তার কারণ ছিল প্রশাসন। পৃথিবীতে যেখানে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে কিন্তু প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা অনেকেই উদাহরণ দেন বিএনপি কিছু করতে পারে না। আমার প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপি করবে কি করে আপনারা (আওয়ামী লীগ) তো নিজেদের দলের চেয়ে প্রশাসনের উপর বেশি ডিপেন্ডডেন্ট। সে কারণে প্রশাসনকে সবচেয়ে নিরপেক্ষ থাকা দরকার চলমান আন্দোলন গণজোয়ারে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য। তবে আন্দোলন সংগ্রাম কোনদিন আটকে থাকে না।
ব্রেকিংনিউজ: বিএনপির আন্দোলনে একটা গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জয়নুল আবদিন ফারুক: গুণগত পরিবর্তন এটাই আমরা হরতাল এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি আগেও পছন্দ করতাম না। কিন্তু আমাদেরকে ২০১৪ সালের আগে বা পরে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল আওয়ামী লীগ। এটাও একটা চক্রান্ত ছিল আওয়ামী লীগ এবং প্রশাসনের। তারা একটা প্ল্যান পরিকল্পিত ভাবে আমাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য অনুপ্রবেশকারী হিসেবে করেছিল। সেই কারণে আমি মনে করি আমাদের নীতিনির্ধারকরা কৌশল করে আন্দোলনে একটা গুণগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন।
ব্রেকিংনিউজ: আগামী দিনে আন্দোলেন জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য আপনাদের কি পদক্ষেপ থাকবে?
জয়নুল আবদিন ফারুক: জনসম্পৃক্ততা তো বিএনপির আছেই। এটাকে শুধু ঘুচিয়ে নেয়া। ওই যে বললাম প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ থাকে অটোমেটিক যে বিএনপি গোছানো দল, জনগণ দেখতে পাবে।
ব্রেকিংনিউজ: দেশবাসী বিএনপিকে কেন ভোট দিবে?
জয়নুল আবদিন ফারুক: শান্তিপূর্ণ একটি দল বিএনপি। চক্রান্তের কোন রাজনীতি বিএনপি কখনও করে না। সেই কারণেই মানুষ বিএনপিকে পছন্দ করে। বিএনপি ক্ষমতায় আসলে দেশে উন্নয়ন হয়। দুর্নীতিটা অনেক কমে আসে। দুর্নীতি যে হয় না সেটা ঠিক না। তবে অনেক কম। দুর্নীতিতে বিএনপি জিরো টলারেন্স নীতেতে বিশ্বাসী। সেই কারণে জনগণ বিএনপিকে পছন্দ করে।
ব্রেকিংনিউজ: সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল সাম্প্রতিক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রভাব কমছে বাংলাদেশে বাড়ছে এর কারণ কী?
জয়নুল আবদিন ফারুক: বাংলাদেশে বাড়ার কারণ হল ভারতে যে অঙ্গরাজ্যগুলো আছে বিশেষত ভারতের সেন্টাল গভর্নমেন্ট ওয়েস্ট বেঙ্গলের সাথে একটা সমঝাতো করতে পারছেন না সেই কারণে একটা বিরোধ আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি যেহেতু ডান ও না বামও না একটি মধ্যমপন্থী রাজনৈতিক দল ভারতের কিছু কিছু আমি নাম বলবো না না রাজনৈতিক নেতারা মনে করে বিএনপি একটা উগ্রপন্থী দল কিন্ত্র আমি মনে করি সেটা সঠিক না। সে কারণে তারা এখন আওয়ামী লীগের উপরও খুব একটা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ব্রেকিংনিউজ: সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
জয়নুল আবদিন ফারুক: ব্রেকিংনিউজ.কম.বিডি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।
ব্রেকিংনিউজ