ইসলাম মহাশান্তির সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান। তাই রাষ্ট্রে বসবাসরত সব ধরনের নাগরিক তথাÑ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইহুদিসহ সব নাগরিকের নির্বিঘেœ মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ইসলাম নিশ্চিত কেেরছ। যেকোনো ধর্মের লোক যারা রাষ্ট্রের প্রকৃত নাগরিক, তারা কেবল শাসকদের অত্যাচার, নির্যাতন ও রক্তচুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদই করবে না, বরং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় বিষয় ও সমস্যাগুলো সম্পর্কেও স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার ন্যায়সঙ্গত অধিকার রাখে। তা ছাড়া তারা রাষ্ট্রের ভালো কাজের জন্য উপদেশ ও মন্দ কাজের জন্য বাঁধা দিতে পারবে। নাগরিকদের এ গুণ সৃজন করতে হলে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার ব্যতীত সম্ভব নয়।
তবে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা শুধু ন্যায়, ইনসাফ ও সততাপূর্ণ কাজের েেত্র প্রযোজ্য। অন্যায়, অসাধুতা, মিথ্যা, দুর্নীতি, প্রতারণামূলক এবং প্যাঁচালো কথা ও কাজের েেত্র নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেনÑ ‘আর যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বল, অথবা সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাও, তবে স্মরণ রেখ; তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে আল্লাহ সম্যক অবহিত’-(সূরা নিসা : ১৩৫)।
তার মানে এখানে একথাই বুঝানো হয়েছে যে, তোমরা যদি সত্য কথা বলার েেত্র পশ্চাৎপদ হও অথবা চাপের মুখে কিংবা সন্ত্রাস ও আক্রমণের ভয়ে অথবা অর্থের লোভে বা উচ্চ পদমর্যাদার লোভে বা অন্য কোনো লালসার বশ্ববর্তী হয়ে প্যাঁচালো কথা বলে মুনাফিক সুলভ আচরণ অবলম্বন করতে থাক; তাহলে জেনে রাখ, দুনিয়ায় সাময়িক সময়ের জন্য পরিত্রাণ পেলেও আখেরাতে এ কঠিন অপরাধের শাস্তি থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাবে না। তবে তোমাদের ল্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়ে থাকে এবং অন্য কারো প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের কোনো প্রশ্ন জড়িত না থাকে বা ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ জড়িত না থাকে তহলে ভিন্ন কথা।
আমাদের প্রিয় নবী সা: এরশাদ করেছেনÑ
‘আমার পরে এমন কতিপয় শাসকের আবির্ভাব হবে, যারা তাদের মিথ্যাচারে সহযোগিতা করবে এবং জুলুম ও স্বৈরাচারে মদদ যোগাবে। তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই এবং আমিও তাদের নই’। (নাসাঈ : অধ্যায়- ব্যবসা-বাণিজ্য)।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা: সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কার্যের অনেক বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রাক্কালে সাহাবায়ে কিরামদের অভিমত গ্রহণ করতেন। এতে করে সিদ্ধান্তের েেত্র একদিকে যেমন সবার চিন্তাপূর্ণ ভাবধারা ও মতামতের প্রতিফলন ঘটত, ঠিক অপর দিকে সাহাবিরা বুঝতেন যে, তাদের অভিমত প্রকাশের েেত্র যথাযথ মূল্যায়ন করা হলো। তাই ওই সিদ্ধান্তে সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করতেন। তাতে করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অনেক সহজ হতো। শুধু নির্ধারিত ফোরামে পরামর্শ বা মতামত প্রদান ছাড়া চিঠিপত্র প্রেরণের মাধ্যমেও স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করা যায়।
আবার খোলাখুলি মত প্রকাশের বিধানও ইসলাম অনুমোদন করে। এক সময় ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা: তার খিলাফতের সূচনালগ্নে বক্তব্য দানকালে যথারীতি মতামত প্রকাশের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। আবার ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রা: খিলাফতের আসনে সমাসীন হওয়ার পর সাহাবীরা তার কাছে পত্রের মাধ্যমে মতামত প্রকাশ করতেন।
একদিন হজরত আবু উবায়দাহ রা: ও মুয়ায ইবনে জাবাল রা: তার কাছে একটি যৌথ পত্র লিখলেন। এ পত্রে খিলাফতের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং পরকালের জবাবদিহিতা সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। পত্রের বক্তব্য এখানে তুলে ধরা হলোÑ ‘আশা করি, আপনি আমাদের লিখিত পত্রের প্রকৃত মূল্য দিবেন। আমরা শুধু আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু ও হিতাকাক্সী হিসেবেই এ চিঠি লিখেছি’-( সূত্র: ওমর ইবনুল খাত্তাব, পৃষ্ঠা নম্বর-৩০২)।
আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ৩৯ ধারায়ও বাক বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—-
39(1): Freedom of thought and Conscience is guaranteed.
(2) Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the interests of the Security of the State, friendly relations with foreign States, Public order, decency or morality, or in relation to contempt of court defamation or incitement to an offence-
(a) the right of every citizen to freedom of Speech and expression ; and
(b) freedom of the press, are guaranteed.
জাতিসঙ্ঘের আইনেও স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের কথা বলা হয়েছে। বাক স্বাধীনতা বা মতামত প্রকাশের সুযোগ থেকে জনগণ বঞ্চিত হলে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রের যেকোনো শাসকের উচিত নাগরিকদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়া।
লেখক:
ড. বি এম শহীদুল ইসলাম
প্রবন্ধকার
Naya Diganta