লিখুন, অন্যদের মতো চুপ হয়ে যাবেন না

গতকাল দুপুরে শাহবাগ পার হতে দেখি রাস্তার দুই পাশে সারি সারি পুলিশের গাড়ি। বেশির ভাগই রিকুইজিশন করা। পশ্চিম পাশে একটি জলকামান, আগের রাতে যেটি ব্যবহৃত হয়েছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে। পুলিশ সদস্যদের দেখে মনে হলো, তাঁরা রণসজ্জায় সজ্জিত।

রাস্তার মোড়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা টিভি ক্যামেরায় পোজ দিয়ে বলছেন, আজ (সোমবার) পরিস্থিতি শান্ত আছে। কোথাও গোলযোগ হয়নি। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, আগের দিন শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে কেন পুলিশ চড়াও হলো? তাঁর মুখস্থ জবাব, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যা যা করণীয় তাঁরা সেটুকুই করেছেন।

উল্লেখ্য, রোববার বিকেলে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে শত শত শিক্ষার্থী শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন। তাঁরা সেখানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলেন। অনেকটা পাঁচ বছর আগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মতো। চারপাশে অপেক্ষমাণ যানবাহনের যাত্রীরা শিক্ষার্থীদের সমাবেশের প্রতি মৌন সমর্থন জানাচ্ছিলেন। কারও চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরাও চারদিকে বেষ্টনী তৈরি করেছিলেন, যাতে শাহবাগ মোড়ে যানবাহন প্রবেশ করতে না পারে।

কিন্তু রাত আটটার দিকে হঠাৎ পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে ত্রিমাত্রিক আক্রমণ চালায়। একদিকে তাদের লাঠিপেটা করে, রাবার বুলেট ছোড়ে। অন্যদিকে টিয়ার গ্যাস এবং জলকামান থেকে গরম পানি ছোড়ে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরাও পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। গত জুলাইতে এই শাহবাগ মোড়েই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার দাবিতে সমাবেশ করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে তা ছত্রভঙ্গ করে দিলে সিদ্দিকুর রহমান নামে তিতুমীর কলেজের এক শিক্ষার্থী চোখ হারান।

শাহবাগ থেকে হেঁটে যখন আমরা টিএসসির দিকে যাচ্ছিলাম, রাজু ভাস্কর্যের সামনে তখন শিক্ষার্থীদের বিশাল সমাবেশ চলছিল। ছেলে-মেয়ে প্রায় সমান সমান। তাঁরা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘প্রশাসন যদি থাকে চুপ, দেখবে আবারও রুদ্ররূপ’। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বসা কয়েকজন আন্দোলনকারীর সঙ্গে আলাপ হলো। জিজ্ঞেস করলাম, কোটার আন্দোলনে নাকি জামায়াত-শিবির ঢুকে গেছে? একজন নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে বললেন, এসব অপপ্রচার। ছাত্রলীগে যাঁরা প্রকৃত ছাত্র, তাঁরা এই আন্দোলনে আছেন। আর যাঁদের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে, তাঁরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

তখনো আন্দোলনকারীদের মুখে স্লোগান উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘কোটা প্রথার সংস্কার চাই’, ‘রাজপথ ছাড়ি নাই’। আন্দোলনকারী নেতারা জানালেন, পুলিশের আক্রমণ সত্ত্বেও সারা রাত তাঁরা মিছিল-সমাবেশ করেছেন। তাঁদের আন্দোলন বন্ধ করতে যারা সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে, তাদের ধাওয়া দিয়ে হটিয়ে দিয়েছেন। প্রথম আলোর পরিচয় পেয়ে একজন বললেন, ‘আপনারা আমাদের কথা লিখুন, অন্যদের মতো চুপ হয়ে যাবেন না।’

এরপর প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি কামরুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে যাই। গেট খুলতেই চোখে পড়ে লনে থাকা চেয়ারগুলো পুড়ে কঙ্কালে পরিণত। দেয়ালে বসানো সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়েছে। দোতলা বাংলোটি বলতে গেলে ধ্বংসস্তূপ। প্রতিটি কক্ষ ও বারান্দার মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাচ, পুড়ে যাওয়া ও লন্ডভন্ড হওয়া আসবাব। এমনকি বাড়ির রান্নাঘর ও বাথরুমও আক্রমণকারীদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।

অনেকে উপাচার্যের বিধ্বস্ত বাড়িতে এসে তাঁকে সহানুভূতি জানাচ্ছেন। দোতলার একটি কক্ষে তাঁর ছেলে আশিকের সঙ্গে দেখা। চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। রাতের ধ্বংসযজ্ঞের কথা তিনি ভুলতে পারছেন না। উপাচার্যের বাড়িতে দেখা হলো মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষ নিজামুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে। জানালেন, হামলাকারীদের ঠেকাতে তিনিও মাথায় আঘাত পেয়েছেন।

আমরা যখন কথা বলছিলাম, উপাচার্য আখতারুজ্জামান তখন পাশের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। খবর দিলে এসে বললেন, এখন তিনি নামাজ পড়বেন। আমরা যেন তাঁর জন্য দোয়া করি। জিজ্ঞেস করি, মামলা করেছেন কি না। বললেন, মামলা করেননি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।

উপাচার্য ভবন থেকে যখন কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে পৌঁছাই, তখন বেলা দুইটা। লাউঞ্জ প্রায় ফাঁকা। দু-একজন শিক্ষক গল্প করছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন প্রবীণ শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি, পরিস্থিতি কেন এমন হলো? তিনি বললেন, উপাচার্যের বাসভবনে হামলার ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। কিন্তু এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা অসার হয়ে যায় না। অর্থনীতি বিভাগের আরেক শিক্ষক জানালেন, ছাত্ররা পাঁচ বছর ধরে আন্দোলন করলেও সরকার যখন প্রতিকারের চেষ্টা করেনি, তখন এর দায়ও এড়াতে পারে না।

তবে নবীন-প্রবীণ সব শিক্ষকই কোটা সংস্কার হওয়া প্রয়োজন বলে মত দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম রাব্বানীর সঙ্গে দেখা হতেই জানান, তিনি যখন সংঘর্ষ থামাতে শাহবাগ যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর বাসায়ও আক্রমণের চেষ্টা হয়েছিল। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকলে তিনি তাদের নিবৃত্ত করেন। কিন্তু তখন একদল শিক্ষার্থী তাঁকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তাঁর দাবি, উপাচার্যের বাসায় হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এর সঙ্গে প্রকৃত আন্দোলনকারীদের কোনো সম্পর্ক নেই।

বিকেল চারটায় শিক্ষক সমিতির জরুরি সভায় উপাচার্যের বাসভবনে হামলার বিষয়টি আলোচিত হয়। সেই সভায় কেউ কেউ বলেছেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি লাশ চেয়েছিল, তারাই উপাচার্যের বাসভবনে হামলা করেছে।

শিক্ষক লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে মধুর ক্যানটিনে এসে দেখি প্রচণ্ড ভিড়। ক্যানটিনের ভেতরে ও বাইরে অনেক নেতা-কর্মী। বেশির ভাগই ছাত্রলীগের। পাশের গোলঘরে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান তখন সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পরিস্থিতি কেমন, জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স বললেন, আমরা ক্যাম্পাসে শান্তি চাই। কিন্তু আবু বকর নামে একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে-এই গুজব ছড়িয়ে ক্যাম্পাসে গত রাতে উপাচার্যের বাসভবনে তাণ্ডব ঘটানো হয়েছে। তাঁর দাবি, কিছু সুশীল আছেন, যারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে উৎসুক। তারাই এ কাজে উসকানি দিয়েছেন।

ফেরার পথে দেখি টানটান উত্তেজনা। পুলিশের টিয়ার গ্যাস উপেক্ষা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে তখনো স্লোগান দিচ্ছিলেন। নেতা গোছের একজন তাঁদের শাহবাগের দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আরেকজন আন্দোলনকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, শাহবাগ ও চারুকলার সামনে ছাত্রলীগ ও পুলিশ আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদেরও তৈরি থাকতে হবে।

তখনো আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিচ্ছেন, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’। কিন্তু তখন দৃশ্যের বাইরে চলছিল বৈঠকের প্রস্তুতি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হয়তো তা জানা ছিল না। কিন্তু যেই সচিবালয়ে সেই বৈঠক চলছিল, সেই সচিবালয়ের প্রত্যেক কর্মকর্তাই কোটা সংস্কারের পক্ষে। যদিও তাঁরা মনের কথাটি বলছেন না চাকরি হারানোর ভয়ে।

বিদ্রোহী কবির কবর ছাড়াতেই দেখি ছাত্রলীগের কর্মীরা বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা পথচারীদের বাধা দিচ্ছেন। সাংবাদিকদের প্রতি তাঁদের বিরাগ লক্ষ করলাম একজনের মন্তব্যে। পাশ থেকে হেঁটে যেতে যেতে তিনি বললেন, ‘…ওরা শুধু আমাদের বিরুদ্ধে লেখে।’

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com
Prothom Alo