জাহিদ এফ সরদার সাদী, যুক্তরাষ্ট্রঃ যতই দিন যাচ্ছে ততই এটি পরিষ্কার হচ্ছে যে ‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে সরকার একটি গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। এই ষড়যন্ত্রের সর্বশেষ অধ্যায় হলো তাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাকে ও তার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে আগামী নির্বাচনের বাইরে রাখা। ষড়যন্ত্রের এই অংক মঞ্চস্থ করার জন্য হঠাৎ করে প্রচারিত হলো একটি খবর। সেই খবরটি হলো, বেগম জিয়া অসুস্থ এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন হলে সরকার তাকে বিদেশে পাঠাবে। আর তারপর হটাৎ বেগম জিয়াকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে আনা হলো পিজি হাসপাতালে।
ষড়যন্ত্রের শুরু হয়েছে বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়েরের মাধ্যমে। এরপর তার ৫ বছরের কারাদণ্ড। এই দৃশ্যেরই অংশ হলো তার জামিন নিয়ে টাল বাহানা এবং তার কারাদণ্ড ৫ বছর থেকে বৃদ্ধি করে ১০ বছরে উন্নীত করার আরজি নিয়ে হাইকোর্টে আপিল তথা রিভিশন মামলা দায়ের। বেগম জিয়াকে নিয়ে যে খেলা শুরু হয়েছে তার প্রতিটি পর্যায়ে দেখা যায় খেলাটি শুরু করে সরকার।
এখন চলছে বিদেশ পাঠানোর পর্ব। এই পর্বের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। তখন বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছিল যে ফখরুদ্দিন মঈনুদ্দিনের মিলিটারী নিয়ন্ত্রিত সরকার মাইনাস টু খেলা খেলছে। অর্থাৎ রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনা উভয়কেই মাইনাস করা। সেটি সফল হয়নি।
ভোটার বিহীন নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখল করার পর শুরু হয় আওয়ামী লীগ সরকারের মাইনাস ওয়ান খেলা। মাইনাস ওয়ান মানে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে আউট করে দেওয়া। এই পর্যায়ে তারা বেগম জিয়াকে কারাগারে ঢুকাতে সক্ষম হয়েছে। এখন তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারলেই পথের রাজনৈতিক কাঁটা দূর হয়।
গণতন্ত্রের ‘মা’ বেগম জিয়াকে নির্বাসনে পাঠানোর খেলা শুরু হয়েছে গত ২৮ মার্চ বুধবার। ঐ দিন জিয়া চ্যারিট্যাবল ট্রাস্ট মামলার শুনানী শুরু হওয়ার কথা ছিল। বিএনপি এবং দুদক উভয় পক্ষের আইনজীবিরা বেলা ১০ টার মধ্যেই বকশী বাজারের কোর্টে হাজির হন। বিচারক সেই আগেরজনই, আকতারুজ্জামান। তিনি এজলাসে বসেন সাড়ে ১০ টায়। দেখা গেল যে অভিযুক্তদের মধ্যে দুই জনকে পুলিশ হাজির করেছে।
কিন্তু বেগম জিয়া নাই। কারা কর্তৃপক্ষ জানায় যে তিনি অসুস্থ। তাই তাকে হাজির করা যায়নি। বিএনপির আইনজীবিরা জানতে চান যে কবে থেকে তিনি অসুস্থ, তার অসুখের ধরণ কি, সেটি কতদূর গুরুতর ইত্যাদি। কিন্তু সরকার, দুদক বা কারাগারের তরফ থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তখন তার অবস্থা জানার জন্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে চাইলে কারা কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয় এবং ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার বেলা ৩ টায় মির্জা ফখরুলকে কারাগারে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
যখন মির্জা ফখরুল কারাগারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ করে বেগম জিয়ার গুলশান অফিসে কারাগার থেকে টেলিফোনে জানানো হয় যে মির্জা ফখরুলের কারাগারে যাওয়ার কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি জেলখানায় বেগম জিয়ার সাথে দেখা করতে পারবেন না। কেনই বা তাকে সাক্ষাতের পারমিশন দেওয়া হলো এবং কেনই বা ১৬ ঘন্টার মাথায় সেই পারমিশন উইথড্র করা হলো, সে সম্পর্কে কাউকে কিছু জানানো হলো না। তারপর আরো ২ দিন পার হয়ে গেছে। ৩১ মার্চ শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকার বা জেল কর্তৃপক্ষ কেউই জানায়নি যে বেগম জিয়ার কি অসুখ হয়েছে। বলা হচ্ছে যে তার নাকি জ্বর হয়েছিল। সেই জ্বর ছেড়ে গেছে। মৃদু জ্বর হলে তাকে বকশী বাজার আদালতে নেওয়া হয়নি কেন? মির্জা ফখরুলের জেলখানায় যাওয়ার পারমিশন প্রত্যাহার করা হলো কেন? এসবের কোনো জবাব নাই।
মির্জা ফখরুল সাংবাদিক সম্মেলন করে পরিষ্কার জানতে চাইলেন যে ‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম জিয়ার কি হয়েছে সেটি দেশবাসীকে জানানো হোক। এ ব্যাপারে সরকার মুখ খুলছে না কেন? জাফর ইকবালের আঘাতের পর যদি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি খরচে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিলেট থেকে ঢাকা আনা যায়, ঢাকায় প্রধান মন্ত্রী তার সাথে দেখা করতে পারেন এবং সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ দপ্তর আইএসপিআর থেকে তার হেলথ্ বুলেটিন প্রচার করা যেতে পারে তাহলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বা অসুখ সম্পর্কে সরকারিভাবে কোনো বুলেটিন বা খবর প্রকাশ করতে এত কার্পণ্য কেন?
বিএনপির যে দাবি করেছে সেটি অত্যন্ত ন্যায্য। তারা চেয়েছে প্রকৃত খবর এবং দেশনেত্রীর আশুমুক্তি। দলতো ঠিকই বলেছে যে বেগম জিয়ার তো জামিন হয়েই আছে। অর্থাৎ হাইকোর্ট তো তাকে জামিন দিয়েইছে। সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার জজও সেই জামিন আটকাননি। তারপরেও হঠাৎকরে তার জামিনের শুনানী দেড় মাস পিছিয়ে ৮ মে করা হলো কেন? উদ্দেশ্য তো খুবই পরিষ্কার। যত লম্বা সময় ধরে তাকে জেলে আটকে রাখা যায় ততই তাদের জন্য ভাল। আর এই ফাঁকে তাকে নিয়ে নতুন প্ল্যান প্রোগ্রাম করা যাবে। মির্জা ফখরুলের কথা লুফে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে ডাক্তাররা বললে সরকার চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠাতে রাজি।
শুধু বিএনপি নয় সরকারের মনের কথা ধরতে পেরেছেন দেশের আমজনতা। বিএনপি বলেছে, বেগম জিয়াকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। প্যারোলে ছাড়লে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। প্যারোল প্রসঙ্গটি উত্থাপনের সাথে সাথেই সরকার পক্ষ খামোশ মেরে গেছে। এখন বলা হচ্ছে যে সিভিল সার্জন তাকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং তার কোনো নতুন অসুখ দেখা যায়নি। তার যে হাঁটুর ব্যাথা সেটা অনেক পুরানা। এদিকে মির্জা ফখরুল ঠিক মতই বলেছেন যে আগে তাকে নিঃশর্তভাবে তাকে মুক্তি দেওয়া হোক। এরপর নেত্রী নিজেই ঠিক করবেন যে তিনি দেশে চিকিৎসা নেবেন, নাকি বিদেশে চিকিৎসা নেবেন।
আজ ৭ই এপ্রিল শনিবার অনেককে বলতে শোনা গেছে যে ‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর সরকারি পরিকল্পনা মাঠে মারা গেছে। হটাৎ সরকার বেগম জিয়াকে তড়িঘড়ি করে পিজি হাসপাতালে এনে গাড়ি থেকে নামার পর তাকে পারেনি হুইল চেয়ারে বসাতে। আগেপরে, ভবনের ওপরে-নিচে হাজারো মানুষের কোলাহোল, ছুটোছুটি। তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার কত কী আয়োজন। কিন্তু সেসবের ধারেকাছেও গেলেন না বেগম জিয়া, নিজের পায়ে হেঁটে হাসপাতালে প্রবেশ করলেন আপোষহীন এই জলন্ত আগুন। জাতিকে হুইল চেয়ারে বসালেন না ‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম খালেদা জিয়া।
‘গণতন্ত্রের মা’ বেগম জিয়া ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, অবিচল। তাঁর শির ছিলো উন্নত। চাহনিতে কী অদ্ভূত দৃঢ়তা, কী চমৎকার বিশালতা! পাহাড়ের স্থিরতা ছিলো তাঁর মাথা-না-নোয়া শরীরে, মুখজুড়ে আকাশের স্নিগ্ধতা। মিষ্টি হাসিতে সন্তানদের জানিয়ে দিলেন তিনি, ‘আঘাতে কাবু হতে শেখেননি তোমাদের মা।’ গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে হাসি মুখে ভালোবাসার জলন্ত আগুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আবার কারাগারে ফিরে গেলেন দেশমাতা বেগম খালেদা জিয়া।
“যে মা একটি জাতিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন, যে মা শুধু অবোধ সন্তানদের মুখে হাসি ফোটাতে বারংবার নিজেকে সঁপে দিয়েছেন জুলুমবাজদের হাতে, যিনি আজো সহ্য করে চলেছেন বিভৎস পৈশাচিকতা, নির্মম একাকীত্ব, আমাদের সেই মা, আমাদের নিরপরাধ মা হুইল চেয়ারে বসবেন না এটাইতো স্বাভাবিক, এটাই চিরসত্য। মা আমাদের মাথা নত করেননি, করবেনও না কখনো। এবার সন্তানদের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর পালা”, বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার আবু সায়েম।
এদিকে খালেদা খালেদা জিয়ার এমন আপোষহীনতার কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা উল্লাসে মেতে উঠেন। তার এই আপোষহীন চরিত্র সত্যিই নেতাকর্মীদের কে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন ও সম-অধিকার বাস্তবায়নে যুগ যুগ ধরে ভূমিকা রাখবে।
বেগম জিয়ার অতীত রেকর্ড বলে যে গুরুতর অসুস্থ না হলে দেশ ছাড়ার বান্দা তিনি নন। মিলিটারী কন্ট্রোলড জরুরী সরকারের আমলে তার জন্য ঘরের বাইরে গাড়ি এবং বিমান বন্দরে বিমান রেডি রাখার পরেও তাকে বিদেশ নেওয়া যায়নি। আজও তাকে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরানোর যতই চেষ্টা করা হোক সেটি কোনদিনই ফলবতী হবে না।
লেখকঃ জাহিদ এফ সরদার সাদী
বাংলাদেশের তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক বৈদেশিক উপদেষ্টা এবং বিএনপির বিশেষ দূত।