গাঢ় সবুজ রঙয়ের ওপর হলুদ রেখাওয়ালা একটি ট্রেন এসেছে বেইজিংয়ের কেন্দ্রীয় রেলওয়ে স্টেশনে। ২৬ মার্চ সোমবার। ট্রেনটি সবার কাছেই অচেনা। সেই সাথে বেইজিং শহরে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে কানাঘুষা শুরু হয় যে- উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন রাষ্ট্রীয় সফরে চীন এসেছেন। এক দিন পর অবশ্য সেটাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
অত্যাধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার এই যুগে ট্রেনে চড়ে রাষ্ট্রপ্রধানের বিদেশ সফল বিরল ঘটনা; কিন্তু কিম জং উন বা তার দেশও তো বিশ্বের আর সব দেশের চেয়ে আলাদা। আরো অনেক কিছুর মতো এই ট্রেন যাতায়াতও যেন তাকে পৃথক করে রেখেছে বিশ্ব থেকে। কিমের সফরের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী কৌতুহল শুরু হয়েছে তার ট্রেন নিয়ে। সংবাদমাধ্যমগুলো বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে চেষ্টা করেছে রহস্যময় সেই ট্রেন সম্পর্কে। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে কিমের সফরের ওপর যে বিশদ রিপোর্ট প্রচার করা হয়েছে সেখান থেকেও জানা গেছে অনেক কিছু।
গাঢ় সবুজ রঙের ট্রেনটি সাধারণ ট্রেন থেকে কিছুটা আলাদা। ২১ বগির ট্রেনটি রাষ্ট্রপ্রধানের বাহন হিসেবে বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থার সাথে রাখা হয়েছে আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা। আছে সর্বাধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। একটি কামরায় স্থাপন করা হয়েছে কিমের অফিস। বড় ডেস্কের পেছনে কিমের চেয়ার। তার পেছনের দেয়ালে কোরীয় উপদ্বীপ ও চীনের মানচিত্র। ডেস্কের সামনে কয়েকটি চেয়ার। আরেক কামরার দুই পাশে সারিবদ্ধ সোফা সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে বৈঠকখানা। কামরাগুলোর মেঝে সুদৃশ্য নকশা করা কাঠের। দেয়াল ও সিলিং দেয়া হয়েছে সুন্দর ডিজাইনে। এ ছাড়া আছে কনফারেন্স রুম ও একাধিক বেডরুম। একাধিক জায়গায় বসানো আছে বড় টিভি পর্দা। আছে স্যাটেলাইট ফোনের ব্যবস্থাও। নিরাপত্তা কর্মী ও সফর সঙ্গীদের জন্য থাকার ঘর।
রহস্যময় সেই ট্রেনের রান্নাঘরে পাওয়া যায় উন্নতমানের সব ধরনের খাবার। কোরীয় খাবার ছাড়াও রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্সের খাবার প্রস্তুত করার ব্যবস্থা আছে কিম ও তার সফর সঙ্গীদের জন্য। আছে সব ধরনের পানীয়। পুরো ট্রেনটি বুলেট প্রুফ করে বানানো হয়েছে। ভেতরের সাজসজ্জার কারণে সাধারণ ট্রেন থেকে এটির ওজন অনেক বেশি। ওজনের কারণে এটির গতি ঘণ্টায় ৩৭ মাইল বেশি হয় না।
২৫ মার্চ রোববার সীমান্ত পার হয়ে চীনে প্রবেশ করে কিমের ট্রেন। চীনের সীমান্তবর্তী শহর ড্যাংডংয়ের স্টেশনে থামে ট্রেনটি। সেখানে তাকে স্বাগত জানায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রধান সং তাওয়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। তাদের নিয়েই ৫২০ মাইল পাড়ি দিয়ে পর দিন বেইজিং আসে বিলাসবহুল ট্রেনটি। স্টেশন থেকে তিনটি কালো লিমুজিন গাড়ি আর ২১টি মোটরসাইকেলের এক বহর কড়া নিরাপত্তায় নিয়ে যায় রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায়। সফরে কিমের সাথে ছিলেন তার স্ত্রী রি সেলে জু ও উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কয়েক নেতা। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের সাথে বৈঠক ও কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পরদিন আবার দেশে ফিরে যান কিম।
জানা গেছে, দেশের ভেতরে ও বিভিন্ন অঞ্চলে সফরের সময় ট্রেন ব্যবহার করেন কিম। সে কারণে ট্রেনেই যাতে প্রয়োজনীয় সব কাজ সারতে পারেন তেমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কিমের ট্রেনের জন্য অন্তত ২০টি বিশেষ স্টেশন বানানো হয়েছে। দেশে সাধারণত ৩টি ট্রেনের বহর নিয়ে যাতায়াত করেন এই রাষ্ট্রনেতা। সামনে ও পেছনে নিরাপত্তা দল আর মাঝখানের ট্রেনে থাকেন কিম। তার দাদা কিম ইল সুং ও বাবা কিম জং ইল রাষ্ট্রনেতা থাকার সময়ও ট্রেন ব্যবহার করতেন। অনেকেই ধারণা করছেন কিমের বাবা যে ট্রেনটি ব্যবহার করতেন সেটিই এখন কিম ব্যবহার করছেন। বিমানে চড়ার ভীতি থেকেই তাদের পরিবার ট্রেনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বলেও শোনা যায়। ২০১১ সালে কিমের বাবা রাশিয়া সফরে গিয়েছিলেন ট্রেনে চড়ে। আর বাবার মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেয়া কিমের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এটিই প্রথম বিদেশ সফর।
Naya Diganta