লবিস্ট নিয়োগ ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি: বাগ্‌যুদ্ধ শুরু

যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট (তদবিরকারী) নিয়োগ ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে দেশের রাজনীতি। প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শুরু হয়েছে বাগ্‌যুদ্ধ। দুই দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতারা পরস্পরকে প্রায় প্রতিদিনই বাক্যবাণ ছুড়ে চলেছেন। চলছে কাদা ছোড়াছুড়িও।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভিযোগ, সরকারকে বিব্রত করা এবং দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। এটি দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ও দেশদ্রোহের শামিল। বিপরীতে বিএনপির ভাষ্য, দলের পক্ষ থেকে কখনোই কোনো লবিস্ট নিয়োগ করা হয়নি; বরং আওয়ামী লীগই দেশের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে।

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের কাছে নানা তথ্য তুলে ধরার জন্য কোনো দল বা ব্যক্তির নিয়োগকৃত লবিস্ট ফার্ম কাজ করে থাকে। এই লবিস্টরা কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, এমনকি কোনো দেশের পক্ষ নিয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের তথ্য দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের জন্যও তথ্য তুলে ধরা এই লবিস্টদের কাজ। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এ রকম শত শত প্রতিষ্ঠান বা ফার্ম রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।

এই লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টিই হঠাৎ দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মন্ত্রীরা বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন চিঠি পেয়ে সভা করেছে। দুদক, বাংলাদেশ ব্যাংকও তৎপর হবে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা প্রতিদিনই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন। গত ২৭ জানুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, নির্বাচন সামনে রেখে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট ও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিএনপি লাখ লাখ বা কোটি কোটি ডলার খরচ করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। এটা বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে দেশবিরোধী চক্রান্ত। এই টাকার পাই পাই হিসাব নেওয়া হবে।

অতীতেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানো, জঙ্গিদের রক্ষা, জাতির পিতার খুনিদের বাঁচানো, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করেছিল- এমন অভিযোগ তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য এমন অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে বিএনপি।

লবিস্ট বনাম জনসংযোগ: সম্প্রতি র‌্যাবসহ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারির পর হঠাৎ করেই লবিস্ট নিয়োগের প্রসঙ্গটি সামনে আসে। এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সংসদে ঘোষণা দেন, সাত কর্মকর্তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রকাশের পর দেশের শীর্ষস্থানীয় এক পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় ‘বিএনপির শাসনামলে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ২০০৪ সালের ২৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, যা ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়।’ অবশ্য আওয়ামী লীগ এই খবরকে ‘আজগুবি’ খবর হিসেবে অবিহিত করে প্রত্যাখ্যান করেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম গত ১৮ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেন, বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। পর দিন ১৯ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ব্লুস্টার স্ট্র্যাটেজিস এলএলসি এবং রাস্কি পার্টনারস নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছিল বিএনপি। লবিস্ট নিয়োগে বিএনপির খরচের হিসাব জানতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সরকারের লবিস্ট নিয়োগের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন, ‘হ্যাঁ, সব সময় পিআর (জনসংযোগ) ফার্ম নেওয়া হয়, যাতে বিনিয়োগ বাড়ে, উৎপাদন বাড়ে, আমরা যেন বেশি রপ্তানি করতে পারি। কিন্তু বিএনপির কাজটি কী ছিল?’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি একাধিক ফোরামে বিএনপির ‘লবিস্ট নিয়োগের’ কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিএনপি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। তারা একদিকে অপপ্রচারে বিনিয়োগ করেছে, অন্যদিকে ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ সেজে ব্যাখ্যাও দাবি করছে। এটা বিএনপির অপরাজনীতি।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সমকালকে বলেছেন, বিএনপি যতই অস্বীকার করুক, দেশের বিরুদ্ধে বিদেশে তাদের লবিস্ট নিয়োগের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ সরকারের কাছে আছে। ঢাকার নয়াপল্টনের বিএনপি কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়ে লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছে তারা। এ ব্যাপারে সংশ্নিষ্ট বিভাগ ও দপ্তরকে জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির পাল্টা অভিযোগ: বিএনপি বলছে, ২০০১ সালে তারা সরকারে আসার পর আওয়ামী লীগ লবিস্ট নিয়োগ প্রথা চালু করে। সরকারকে উৎখাত করতে সে সময় একাধিক লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল আওয়ামী লীগ, যার ধারাবাহিকতা এখনও রক্ষা করছে। এখন জনগণের টাকায় এসব লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে তাদের সব অপকর্ম আড়াল করতে চাইছে বলেও অভিযোগ বিএনপির।

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভাষ্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশপ্রধান, র‌্যাবপ্রধানসহ সাতজন সরকারি কর্মকর্তার ভিসা বাতিল এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর থেকে সরকার অপপ্রচার শুরু করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আড়াল করার জন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকায় লবিস্ট নিয়োগ করছে সরকার।

বিএনপির কয়েকজন নেতার দাবি, বিএনপি নয়, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আব্দুল সাত্তার নামে একজন ব্যক্তি ব্লু স্টার স্ট্র্যাটেজিস এলএলসি ও রাস্কি পার্টনার্স নামে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০১৮-১৯ সালে চুক্তি করেছিল। আব্দুল সাত্তার বিএনপির কোনো পদে নেই। তবে চুক্তিতে ঠিকানা হিসেবে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে- এটা ঠিক। এর জন্য বিএনপিকে তো দায়ী করা যায় না।

অবশ্য নেতারা এটাও বলছেন, দেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রবাসী কোনো পদক্ষেপ কোথাও নেন, দেশের প্রতি তার ভালোবাসার জন্য যদি কিছু করেন- এ ধরনের ‘দেশপ্রেমিক পদক্ষেপকে’ বিএনপি সাধুবাদ জানায়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, বিএনপি লবিস্ট নয়, উন্নয়ন সহযোগীদের চিঠি দিয়েছে। বিএনপি কখনও লবিস্ট নিয়োগ করেনি। উল্টো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ধামাচাপা দিতে অবৈধ সরকার জনগণের করের টাকায় আমেরিকায় লবিস্ট নিয়োগ করেছে। যেটা তারা ২০০৫ সাল থেকে করে আসছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। দেশের ১৬ থেকে ১৭ কোটি মানুষই তো লবিস্ট। যারা গুম ও খুন হচ্ছে, তাদের বাবা-মায়ের কান্না ও চিৎকার বিশ্ববাসীর কানে যায়। বিদেশিরা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে আসতে চান। কিন্তু সরকার তাদের আসতেও দিচ্ছে না। এতেই প্রমাণ হয়, বাংলাদেশে এসব ঘটনা ঘটছে। সেটা তুলে ধরার জন্য অর্থ ব্যয় করে আলাদাভাবে লবিস্ট নিয়োগের প্রয়োজন তো হয় না।

উৎসঃ samakal