“রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যখন বাদ দেওয়া হলো, তখন কেন চুপ ছিলে ? এখন দেখো ধর্মনিরপেক্ষতা তোমাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে কি না ?”

আরিফ সাহেব হঠাৎ করে মারা গেলেন। মৃত্যুটা যে এত তাড়াতাড়ি হবে সেটা ঠাওরই করতে পারেননি তিনি। ছেলে মেয়েগুলো তো এখনও ছোট, হঠাৎ করেই যে রুহু কবজ হয়ে যাবে তা ছিলো ধারণার অতীত। তবে এখন তিনি কেবলই একটি নিথর দেহ।মৃত্যু হলেও আরিফ সাহেব সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। দেখছেন- তার পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে স্ত্রী। অবুঝ মেয়েটা বলছে- “বাবা চোখ খুলো না, দুষ্টুমি করে বন্ধ করে রেখেছো কেন ? আমি কিন্তু কাদবো।” বেচারা বুঝতেই পারছে না- এ চোখ আর খুলা যাবে না।

আরিফ সাহেবের গোসলের প্রস্তুতি চলছে। আসছে কাফনের কাপড়, হাড়িতে পানি গরম হচ্ছে বরই পাতা দিয়ে। আত্মীয়-স্বজনের তাড়াহুড়োটা বেশি। সবাই চায়- যত দ্রুত দাফন-কাফন সেরে বাসায় যাওয়ায় জন্য। কালকে অফিস আছে, বাচ্চাদের ক্লাস-হোমওয়ার্ক সবই তো করতে হবে, কি বলেন ?
আরিফ সাহেবের গোসল শুরু হলো। হাল্কা গরম পানিতে সাবানের ফ্যানা দিয়ে ধোয়া হচ্ছে আরিফ সাহেবের শরীর। উফ ! তারপরও কি ব্যাথ্যা। ব্যাথ্যার এত তীব্রতা তিনি কখনই অনুভব করেনি।পরানো হলো কাফন। এরপর আবার সবার কান্নাকাটি। মসজিদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আরিফ সাহেবকে। ব্যবহার করা হয়েছে একটি স্টিলের খাটিয়া। বোকা মানুষগুলো বুঝেই না- এই লোকটি এতক্ষন তাদের মতই মানুষ ছিলো। তারা নিজেরাই এই স্টিলের খাটিয়ার উপর একবার শুয়ে দেখুক তো, কত ধানে কত চাল। ফাকা ফাকা স্টিলপাতের উপর শুতে কত ব্যাথা তখন বুঝবে।

কিছুক্ষণ আগে আরিফ সাহেবের জানাজা শেষ হলো। ইমাম সাহেব বললেন- এই লাশ দেখে সবাই আমল শুদ্ধ করেন। মনে রাখবেন- যতই ধন সম্পদ কামাই করেন, কোন লাভ নাই, পরকালে টাকা পয়সা যাবে না, যাবে শুধু আমল-আকিদ্বা। যার আমল আকিদা ভালো সেই কবরে ফেরেশতাদের উত্তর দিতে পারবে, বাকিরা পারবেন না। আর যে কবরের সওয়াল জওয়াব না দিতে পারবে তার কবরেই শুরু হয়ে যাবে কঠিন শাস্তি।যথারীতি কবরে নামানো হলো আরিফ সাহেবকে। আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কবরের উপরের অংশ। ধিরে ধিরে কমে যাচ্ছে আলো। এক সময় সকল আলোই মুছে গেলো আরিফ সাহেবের চোখ থেকে। আলোর আর বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব নেই।একটু পর আরিফ সাহেবে টের পেলেন তার আত্মীয় স্বজনরা কবর দেওয়া শেষ করে দূরে সরে যাচ্ছেন। সময় যাচ্ছে, সময় আসছে……মনে হচ্ছে আরিফ সাহেব নতুন কোন জগতে প্রবেশ করছেন।

হঠাৎ করে দুই ব্যক্তি এসে আরিফ সাহেবকে ডাকা শুরু করলো-
হে আরিফ উঠো ! উঠো ! আমরা দুজন ফেরেশতা এসেছি তোমার কবরে সুওয়াল জবাব নিতে। দু’জনের কথা শুনে আরিফ সাহেবের অন্তরটা যেন পানি হয়ে গেলো। তিনি মারাত্মক ভয় পেয়ে গেলেন। হুরহুর করে উঠার চেষ্টা করলেন, কিন্তু এত ছোট কবরে কিছুই করতে পারলেন না।আগত দুই ফেরেশতা বললো-আরিফ বলো তো – তোমার ধর্ম কি ?? তুমি কোন ধর্মের অনুসারী ??

আরিফ সাহেব অনেক কষ্টে তার তার ধর্মের নাম মনে করতে চেষ্টা করলো।
কিন্তু হায় !! ‘ইসলাম’ শব্দটা কিছুতেই মুখ দিয়ে আসতে চাইছে না। অনেক মুখ নাড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
হঠাৎ করে মুখ দিয়ে আরিফ সাহেবের ফস করে বের হয়ে গেলো-
“আমার ধর্ম নেই, আমি ধর্মনিরপেক্ষ !”

ফিরিশতারা চিৎকার করে উঠলো ! কি ধর্মরিপেক্ষ ?
আরিফ সাহেব হাজারো চেষ্টা করতে থাকলেন- ইসলাম শব্দটি উচ্চারণ করার জন্য, কিন্তু ‍মুখ দিয়ে শুধু ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ নামক শব্দটাই বার বার বের হতে থাকলো।
আরিফ সাহেবের মনে পড়ে গেলো, মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগেই সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম পরিবর্তন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করা হয়েছিলো। তখন আরিফ সাহেব চুপ থেকেছিলেন, ভেবেছিলেন- ‘থাক না, ইসলাম বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ হলে সমস্যা কোথায় ? ধর্মনিরপেক্ষতা তো ভালো জিনিস, আই লাইক সেক্যুলারিজম (ধর্মনিরপেক্ষতা)।”

কিন্তু সেই ছোট আমলের বদলা যে কবরের ভেতর দুই ফিরিশতার সামনে এত কঠিনভাবে দিতে হবে তা তিনি আগে অনুধাবন করতে পারেননি। দুইজন ফিরিশতা রাগ করে চলে গেছেন।
অবাক বিষয়!! ফেরেশতারা যাওয়ার পর পরই কবরের দুটো দেয়াল কেন যেন এক হয়ে যাচ্ছে, পিশে যাচ্ছে আরিফ সাহেবের শরীর। কোথা থেকে একটা বড় অজগর বের হয়ে এসে হঠাৎ আরিফ সাহেবের গলা পেছিয়ে ধরেছে। আরিফ সাহেব সাপ খুব ভয় পান। তিনি বাচাও বাচাও বলে চিৎকার করছেন।কিন্তু অন্ধকারে কেউ এগিয়ে আসছে না। শুধু অদৃশ্য থেকে উচ্চারিত হচ্ছে-
“রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যখন বাদ দেওয়া হলো, তখন কেন চুপ ছিলে ? কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্ম হিসেবে মেনে নিলে। এখন দেখো ধর্মনিরপেক্ষতা তোমাকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে কি না ?”

Prothom alo 247.com