হঠাৎ করেই গত পাঁচ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় প্রভাবাধীন থাকা প্রতিবেশীরা বেরিয়ে যাচ্ছে দেশটির বলয় থেকে। একই সময়ে চীনের প্রভাব লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে।২০১৪ সালে ভারতে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেশটির পররাষ্ট্রনীতি একের পর এক ব্যর্থ হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ভারতের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমগুলোও। মোদির ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, ‘নেইবার্স ফার্স্ট পলিসি’ কিছুই যেন কাজে আসছে না।সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লেখা এক নিবন্ধে দেশটির পদ্মভূষণ পাওয়া সাংবাদিক টিজেএস জর্জ মন্তব্য করেন, ‘এই অঞ্চলে একটি নতুন ভূ-রাজনীতি শুরু হয়েছে- যেখানে ভারত কোনো পক্ষ নয়। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের ভূমিকা কমিয়ে দিয়েছে।’তিনি এর কারণ হিসেবে প্রধানত তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করেছে: প্রথমত, জওহরলাল নেহেরুর সময়- যখন ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সবচেয়ে কার্যকর ছিল- তখনও দিল্লি ও তার রাষ্ট্রদূতরা ছোট প্রতিবেশীদের ওপর আধিপত্য চালাতো।
সে সময় থেকেই ভারতকে অপছন্দ করতে শুরু করে পাশের দেশগুলো।দ্বিতীয়ত, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশীদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন পাশের দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি করেছে। তৃতীয়ত, চীন এই অঞ্চলে আগের চেয়ে বেশি প্রভাব তৈরি করতে শুরু করেছে।এই সূত্র ধরেই মালদ্বীপ, নেপাল, মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের মধ্যে যে পরিমাণ ভারতবিরোধী মনোভাব দেখা যাচ্ছে, তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি।নেপালের ভূমিকম্পের সময় ভারতের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ও বড় ভাইসূলভ আচরণ এবং ২০১৫ সালে দেশটিতে মাধেসি বিক্ষোভ উস্কে দেয়াসহ নানা কারণে চীনের বলয়ে চলে গেছে নেপাল। দেশটির অর্থনীতিতে নজিরবিহীন ভূমিকা রাখছে চীন।৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমারকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে ভারত। এছাড়া চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পেও দেশটি। শ্রীলঙ্কাও বর্তমানে চীনা ‘দখলে’। টিজেএস জর্জের ভাষায়, ‘সারা শ্রীলঙ্কাই যেন চীনময়।’গত ফেব্রুয়ারিতে অভ্যন্তরীণ সংকটের সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে মালদ্বীপও ভারতের মুখে চপেটাঘাত করে। চীন সেখানে নতুন খেলোয়াড়ের ভূমিকা নিয়েছে। তারা জানিয়ে দিয়েছে, দেশটিতে ভারতের যেকোনো ভূমিকার বিরোধিতা করবে তারা। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন বর্তমানে চীনের ওপর সবচেয়ে নির্ভরশীল অংশীদার।
এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রটি নিজের সমুদ্রসীমায় ভারতের সঙ্গে টহল দিয়ে এলেও সম্প্রতি এ বিষয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে তাদের। এখন থেকে দেশটির বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে টহল দেবে পাকিস্তানের নৌ-বাহিনী।
সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে- ঠিক এখনই বলা যাচ্ছে না। টিজেএস জর্জ লিখেছেন, ‘মুসলিমপ্রধান দেশ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলেও এই দেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মানসিকতা প্রবল। সীমান্ত সমস্যা এর প্রধান কারণ। বলা যায়, বাংলাদেশে ভারতের বন্ধুর চেয়ে শত্রু বেশি।’বাংলাদেশের সঙ্গে আচরণে ভারত বরাবরই আধিপত্যমূলক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। চলতি বছর মোদির বাংলাদেশ সফরের কথা থাকলেও তা আর হচ্ছে না বলেই মনে করা হচ্ছে। এর কারণ, তিস্তা ইস্যুতে ভারত কোনো সুখবর দিতে পারবে না। আর এই মুহূর্তে দেশটির কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দাবি তিস্তার পানি।চলতি মাসে লন্ডনে হাসিনা-মোদি বৈঠকের কথা রয়েছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম আনন্দবাজারের তথ্যমতে, সেখানেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে কোনো কথা হবে না।
এর আগে ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিতর্কিত মন্তব্য করে বাংলাদেশীদের আরো ক্ষুব্ধ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিপুল অভিবাসী যাচ্ছে, যা ‘পরিকল্পিত’ ও চীনের সহায়তায় ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ‘প্রক্সি যুদ্ধ’।
সম্প্রতি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এক সংসদ সদস্য বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতের বাংলাদেশ দখল করে নেয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে ‘মহাভুল’ বলে আখ্যা দিয়ে স্থানীয় একটি টিভি চ্যানেলকে বলেন, এ কারণেই গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে আসামে মুসলিমরা ব্যাপকভাবে পাড়ি জমিয়েছে। এসব মন্তব্য বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মানসিকতা তুঙ্গে নিয়ে গেছে। ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকা পছন্দ করে এখানকার মানুষ।
এরপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে আসাম ইস্যু। ‘অবৈধ বাংলাদেশী’ অভিযোগে আসাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার শঙ্কায় আছে রাজ্যটির ৫০ লাখ মানুষ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সম্প্রদায়িক এজেন্ডা নিয়েই আসাম সরকার তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। কারণ মুসলিম বাসিন্দাদের আসাম থেকে বিতাড়িত করার কথা বলা হলেও ১৯৭১ সালের পর যেসব হিন্দু সেখানে গিয়েছে, তাদের আশ্রয় দেয়া হবে। বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিতীয় রাখাইন হতে যাচ্ছে আসাম।কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আসামে বসবাসরত ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে গত ছয়মাস ধরে তারা ওই তালিকা হালনাগাদ করছে।একই সময়ে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দেশটির প্রভাব। বাংলাদেশ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সমরাস্ত্র কিনে চীন থেকে। চীনা প্রশাসনও এই বাণিজ্য ধরে রাখতে চাইছে। অবকঠামোতেও বিপুল বিনিয়োগ চীনের।সম্প্রতি ভারতীয় সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগ চায়। যে এখানে বিনিয়োগ করবে, তার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ হবে সরকার। অবশ্য এতে সন্তুষ্ট নয় ভারত সরকার।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরই ভারতীয় সেনাপ্রধান ও বিজেপি নেতা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিতর্কিত মন্তব্য করেন।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা দেশে। অবশ্য এ নিয়ে এখনো আছে শঙ্কা ও অনিশ্চয়তা। বিএনপি বলছে, নিরাপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না তারা। অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বক্তব্য, তাদের অধীনেই নির্বাচন হবে। তার ওপর খালেদা জিয়াকে কারান্তরীণ করে রাখায় নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার বিষয়টি মুখ্য হয়ে দেখা দেবে ভোটারদের কাছে। এই অঞ্চলের মানুষ ভারতের আধিপত্য মানতে চায় না। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, ভারত সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দেবে না বাংলাদেশের মানুষ। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবর্তনের প্রভাবও পড়বে দেশের রাজনীতিতে। সেইসঙ্গে চীনের ভূমিকাটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সবমিলিয়ে কোন পথে যাবে বাংলাদেশ- এ নিয়ে প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মধ্যেও।
Amardesh247.com