নির্বাচনে যেভাবে মোড় ঘোরাতে চায় বিএনপি

দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি। একই দাবিতে বিগত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বয়কট করেছে দলটি। সম্প্রতি সেই দাবির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন। এরই মধ্যে দলটি আবার আসন্ন দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথাও জানান দিয়েছে। ফলে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। এই নির্বাচনকেই রাজনৈতিক মোড় ঘোরানোর সুযোগ হিসেবে দেখছে দলটি।দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অভিযোগ রয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ও আগামী সিটি নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মূলত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি থেকে বিএনপি দূরে সরে যাচ্ছে।তবে কেন্দ্রীয় নেতারা মনে করছেন, নির্দলীয় সরকারের দাবি ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনের বাহক হচ্ছে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত। তাই সিটি নির্বাচনে জয়-পরাজয়কে প্রাধান্য না দিয়ে এর মাধ্যমে প্রধান টার্গেট হচ্ছে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি।জ্যেষ্ঠ নেতাদের ভাষ্য, বিএনপির প্রধান লক্ষ্য, প্রধান এই দুই ইস্যুকে জনগণের দ্বারে দ্বারে সহজে পৌঁছানো।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিএনপি নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের আন্দোলনে রয়েছে। কোনো ইস্যুতেই সেই দাবি ও লক্ষ্য পূরণ করা থেকে পিছপা হয়নি, হবেও না; বরং বিএনপি সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য লড়াই সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। তাই শত হয়রানি-অত্যাচার-নির্যাতনও বিএনপিকে এই দাবির পথ থেকে সরাতে পারবে না।খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন, আগামীতে খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বিএনপির চলমান আন্দোলনের একটি ধাপ। কাজেই একটির সঙ্গে আরেকটির সম্পৃক্ততা রয়েছে। ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ আমরা এই মুহূর্তে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি রাজপথে আন্দোলনের কর্মসূচিও পালন করে যাচ্ছি। মোট কথা হচ্ছে, বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। তাই বরাবরের মতো এবার স্থায়ী পর্যায়ের সকল নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে এবার স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্তের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে, আলাদা গুরুত্বও বহন করে।’নির্বাচন নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনার বিষয়ে মোশাররফ বলেন, ‘…আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে এমন সময়ে সিটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে, যেখানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারান্তরীণ রয়েছেন। আমরা মনে করি খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবির আন্দোলনের অংশ হিসেবেই কারান্তরীণ। তাই বিএনপির টার্গেট হচ্ছে সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনকে বেগবান করে তোলা। বিএনপিকে দুর্বল করতে সরকার দুদককে ব্যবহার করে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনের নামে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। যদিও এই সব করে তাদের শেষ রক্ষা হবে না। ক্ষমতা ছাড়তে হবে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বাধ্য হবে।’

তবে দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিএনপির মূল দাবি একটাই, সেটা হচ্ছে আগামীতে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। আর এখন মূল দাবি, খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বের করে আলাপ-আলোচনা কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে সকল দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং সেই লক্ষ্যে বিএনপি আসন্ন সিটি নির্বাচনকে টেস্ট ম্যাচ হিসেবে নিয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের কারণে দেশের মানুষের নির্বাচনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়েছে।আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর স্থানীয় পর্যায়ের প্রায় সকল নির্বাচন ভোট ছাড়াই দখল করে নিয়েছে। নির্বাচনে জয়- পরাজয় বড় কিছু নয়, আমরা সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করতে চাই এবং করতে সক্ষম হব বলে দৃঢ় বিশ্বাস যে, এই সরকারের অধীনে স্থানীয় পর্যায়েও অতীতে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয়নি, এবারও হবে না। আর জাতীয় নির্বাচনের জন্য তো প্রশ্নই আসে না। এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত হবে খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পূর্বে যে সমস্ত দাবি উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে অন্তত সমঝোতার জায়গায় এসে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া।’১ এপ্রিল রাতে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যৌথসভা করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস-চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ ও সাংগঠনিক নেতারা। সভায় আসন্ন দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও সভায় থাকা একাধিক নেতা সিটি নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন বলেও একটি সূত্রে জানা গেছে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জেনে কার্যালয়ের বাইরে অপেক্ষমাণ দলটির নেতাকর্মী সমর্থকদের মধ্যেও এক ধরনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিলেট থেকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আসা একজন যুবদল নেতা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘ভাই কারে কী বলব? কতকিছুই তো দেখছেন, কি বা করতে পারছেন। এরই মধ্যে প্রায় সময়েই দেখতে পাই, আমরা যারা তৃণমূলে রাজনীতি করি, তাদেরকে সিদ্ধান্ত অনেকটাই কেন্দ্র থেকে একপেশে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্র যেন দায় এড়াতে পেরেই খুশি। বিগত দিনে দাবি আদায়ে দুইবার রাজপথে আন্দোলন করেছি, যার খেসারত দিচ্ছি। আজ দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে, ঘর-বাড়ি, পরিবার-পরিজন ও আপনজনদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। পাগলা কুকুরের মতো খোঁজ করছে পুলিশ। কিন্তু কী করব?’

খানিকটা থেমে ওই নেতা ফের বলতে থাকেন, ‘রক্তে জিয়াউর রহমানের আদর্শ, তাই ঢাকায় এসেও বসে থাকতে পারিনি। ম্যাডাম খালেদা জিয়ার কোর্ট হাজিরাকে ঘিরে রাজপথে নেমে আসি। ঠিক তারপর যা হওয়ার তাই, নাশকতার অভিযোগে রমনা ও শাহবাগ থানায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি হতে হয়েছে। জানি না পুলিশি চোখ এড়িয়ে ঢাকায় কতদিন থাকতে পারব। তাই কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে আকুল আবেদন সাময়িক লাভের আশায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত যেন না নেওয়া হয়, যাতে করে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করা দূরে থাক, নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনও মধ্যপথে গিয়ে থেমে যেতে হয়।’

সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত, নির্দলীয় সরকারের দাবি ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন একই মোহনায় সৃষ্টি। অগ্রসর হচ্ছেও একইভাবে। নির্দলীয় সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন যেমন সরকারের বিরুদ্ধে, তেমনি খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনও সরকারের বিরুদ্ধে। কাজেই বিএনপি তার মূল দাবি নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে সরে এসেছে বা পিছু হঠছে বলা এবং প্রশ্ন করা উভয়ই অবান্তর, বরং দাবি আদায়ে সিটি নির্বাচন হবে বিএনপির টার্নিং পয়েন্ট।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রিয়.কমকে বলেন, ‘বিএনপি তার মূল দাবি থেকে পিছিয়ে পড়ার কোনো সুযোগ নাই। তবে এই মুহূর্তে বিএনপির আন্দোলনের প্রথম টার্গেট হচ্ছে খালেদা জিয়ার মুক্তি। পাশাপাশি সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন আদায়ের আন্দোলন। এগুলো আন্দোলনের অংশ। তাই বিএনপির কাছে বর্তমানে প্রথম শর্ত হচ্ছে- যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিকল্প নাই। কেননা খালেদা জিয়া ব্যতীত বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি, পাবেও না

Amardesh247.com